(বি.দ্র.: আগের পর্ব পড়া থাকা আবশ্যক)
আমি ভুত প্রেত বিশ্বাস করি না। অলৌকিক কোনকিছুতেও আমার বিশ্বাস নেই। আমি জানিনা যারা এসবে বিশ্বাস করেন তারা কেন করেন। হয়তো কারো জীবনে এধরনের অভিজ্ঞতা হয়েছে। আর কেউ কেউ হয়তো কোন কারন ছাড়াই চিত্তের দুর্বলতার কারনে এসব বিশ্বাস করে থাকেন। তবে আমার জীবনে যেহেতু এ ধরনের কোন ঘটনা ঘটেনি তাই আমিও এসব বিশ্বাস করি না। মামার মৃত্যুর ঘটনাটা আমার কাছে একটা রহস্য বলে মনে হচ্ছে - এটাকে অলৌকিক বা অদ্ভুতুড়ে ঘটনা বলে মানতে পারছি না। জলজ্যান্ত একটা মানুষ আমার সঙ্গে কথা বললেন হাসাহাসি, রসিকতা করলেন। যে কিনা মৃত! এ হতে পারে না। আমি এ বিষয়টার একটা তথ্য সংগ্রহে করব বলে ঠিক করলাম। একটা ব্যাপার বেশ ভাল হয়েছে; মামার সাথে আমার দেখা হবার ব্যাপারটা কাউকে জানাইনি আমি; আপাতত কাউকে জানাবও না বলে ঠিক করলাম। এতে করে আমার কাজ করতে সুবিধা হবে।
পরদিন সকালে নাস্তা সেরে বাইরের ঘরে বসে বিরক্ত ভঙ্গিতে টিভি চ্যানেল ঘুরাচ্ছিলাম। ভাবছি মামার বাড়িতে যাব। এমন সময় কেউ এলো-
'কে এইটা - সন্জু না?'
মহিলা কন্ঠ শুনে আমি মুখ তুলে তাকালাম। সাদা শাড়ী পড়া মাঝবয়সী মহিলা। চিনতে পারছি না। এই সমস্যায় হরহামেশাই পরি আমি। অনেকদিন পর পর বাড়িতে এলে আমি কাউকে চিনতে পারি না। অথচ সবাই আমাকে চিনে। এটা ওটা জিজ্ঞেস করে। আমি বিব্রত হয়ে উত্তর দিতে থাকি। না চেনা পর্যন্ত সংকোচ কাটে না।
আমি বোকার হাসি হেসে মাথা উপর নীচ করি দুইবার; চোখে জিজ্ঞাসু দৃষ্টি। অর্থ্যাৎ আমিতো সঞ্জু কিন্তু আপনি কে?'মি নাকি ইটালী গেছিলা?'ততক্ষনাত মামীকে চিনতে পারলাম। তাড়াতাড়ি উঠে মামীকে সালাম করলাম।'জি মামী এই সাতদিনের জন্য আরকি।'
মামী আমার পিঠে হাত বুলালেন। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। আমি ইটালী ঘুরে এসেছি বলেই কি আমার সাথে দেখা করতে এসেছেন? তার স্বামীর শেষ আবাসস্থল থেকে ঘুরে আসা ব্যক্তিকে তার কোন কারনে দেখতে ইচ্ছে করছে? দেখি মামীর চোখ ভিজে উঠেছে। এইনা মেয়ে জাতি!
আমি মামীকে ধরে সোফায় বসালাম। 'তারপর মামী কেমন আছেন? টুসী ওরা কেমন আছে?' - আমি দ্রুত প্রসঙ্গ পাল্টানোর চেষ্টা করি। এখন মামার বিষয়ে আলাপ শুরু করলে নির্ঘাত কান্নাকাটির আসর শুরু হবে। আর সাথে যদি মা’ যোগ দেন তবে তো কথাই নেই। রীতিমত বিলাপ শুরু হবে। মা’ আবার কান্নাকাটিতে বেশ এক্সপার্ট বলা যায়।
'আমাদের খবর নিয়া আর কি করবা? কেমনেই থাকি; খোজখবরও তো নেও না।' - রীতিমত অভিযোগ করে বসলেন তিনি।'না মানে একটু বেশী ব্যস্ত থাকতে হয়তো' - আমি সাফাই গাই।'হ, তোমরা বড় হইছ। বিয়া সাদী কইরা ব্যস্ত হয়ে গেছ। কেমনেই আর খবরাখবর নিবা আমাদের। মাঝে মাঝে আসলেও তো পার।'
এই সময় মা ঢুকলেন। 'টুসীর মা আসছ?'
আমি দ্রুত মা’র কাছে ফ্লোর দিয়ে পাশের ঘরে চলে এলাম। অস্বস্তিকর লাগে আমার এইসব বিষয়ে আলোচনা করতে। তবে মামার বিষয়ে জানতে মামীর সাথে তার বাড়িতে যাওয়া দরকার। মামী যেহেতু এসেছেন তার সাথে চলে যাব ভাবছি। আরে কিছু বিষয়ে জানা দরকার। কিন্তু কিভাবে শুরু করব এটাই বুঝতে পারছি না। মামার মৃত্যু নিয়ে ঘাটাঘাটি করছি এ ব্যাপারটাই বা মামী কেমন ভাবে নেবেন? গতরাতে মা’র কাছ থেকে মামার বিষয়ে অল্পই তথ্য পেয়েছি। মামার মৃতদেহ দেশে আনা নিয়ে নাকি বেশ সমস্যা হয়েছিল। সময়ও লেগেছিল বেশ কয়েকদিন। তবে মা বিস্তারিত কিছু বলতে পারেননি।
মামী ফেরার সময় আমাকে উনার বাড়ি যেতে বললেন। 'তুমি তো ফাঁকি দিলা। কোন কথাবার্তাই হইল না তোমার সাথে। চল যাই - দুপুরে খাওয়া দাওয়া কইরা আবার চইলা আইস।'
মা’ও যাবার জন্য বললেন। 'তোরা মাঝে মাঝে এসে চলে যাস। আত্মীয় স্বজনদের বাড়িও তো যেতে হয়। যা ঘুরে আয়।'
আমি 'ঠিক আছে কি আর করা' ভাব নিয়ে মামীর সাথে চলে এলাম। এটাই তো চাচ্ছিলাম আমি!
ছোটখাট একতলা বাড়ী মামার। পুরো বাড়ী জুড়ে আম কাঠালের গাছ; বেশ কিছু মেহগনী গাছও চোখে পড়লো - বেশ বড় বড় হয়ে গেছে। সামনে ছোট্ট পুকুরের মত; পুকুর ঠিক বলা চলেনা। বোঝা যায় ওখান থেকে মাটি উঠিয়ে বাড়ীর ভিটা তৈরী করা হয়েছে। যার ফলে ঐ পুকুর নামক ছোট ডোবার উৎপত্তি। বেশ কিছু অংশে শব্জী চাষও করেছেন মামী। আর পুরোটা বাড়ী টিন দিয়ে ঘেরা। বিয়ের পর থেকেই এখানে বসবাস তাদের।
মামী আমাকে ঘরে বসিয়ে ভিতরে চলে গেলেন। বেশ অগোছাল ঘর। জিনিসপত্রে ধুলোর আস্তরন। বেশ কিছু কাপড় চোপড় এদিক ওদিক ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে আছে। দেয়ালে তাকাতেই মামার বাঁধানো পোট্রেট চোখে পড়ল। সেই চেহারা - বিশাল গোঁফ। যেমন দেখেছিলাম তাকে সেদিন। এই গোঁফের কারনেই তাকে ছোটবেলায় আমরা অনেক ভয় পেতাম।
মামী অনেকগুলো ছবির এলবাম নিয়ে এলেন। 'সুজন তো বাড়ি নাই। সকালে কোথায় যেন গেছে। তুমি বইসা বইসা ছবি দেখ। এইটা টুসীর বিয়ের ছবি।' একটা এলবামের দিকে ইঙ্গিত করলেন মামী। বিশাল সাইজের ছবির এলবামগুলো। 'আমি তোমার জন্য খাবারের ব্যাবস্থা করি। '
মামীর বড় মেয়ে টুসী। শেষবার যখন দেখেছি তখন বেশ ছোট ছিল। অথচ এখন বিয়েও হয়ে গেছে। কত দ্রুত সময় চলে যায়! তারমানে সুজনও নিশ্চয়ই অনেক বড় হয়ে গেছে।
তবে টুসীর এ্যলবামের প্রতি আমার কোন আগ্রহ হল না। ওটা আলাদা সরিয়ে রাখলাম। অন্যগুলো থেকে একটা দেখতে লাগলাম। প্রবাসী ব্যাক্তির পরিবারের সবচেয়ে প্রিয় বস্তু মনে হয় ছবির এলবাম। প্রিয় মানুষের অবর্তমানে ছবিই হয়ে উঠে তাদের আনন্দের উৎস। ঘর অগোছাল হলে কি হবে। এলবামের প্রতিটি ছবিই যত্ন করে রেখে দিয়েছেন মামী। সবগুলোতেই মামার ছবি।
অনেক ছবিই কমবেশী পরিচিত মনে হল। আমার দেখা; আমাদের বাড়ির এলবামে রয়েছে সম্ভবতঃ। একটা এলবামের কয়েকটা ছবি দেখে অবাক হলাম। পরিবারের গ্রুপ ছবি। মনে হচ্ছে বেশ আগের ছবি। কিন্তু মামীর সাথের লোকটিকে ঠিক মামা বলে মনে হচ্ছে না। মামার বিখ্যাত গোঁফ নেই ঐ ছবিতে। অল্পবয়স্ক বালকের মত লাগছে তাকে!
আমি মামীকে ডাকলাম। এটাকে মামার ছবি মনে হচ্ছে না আমার কাছে। তিনি তো তার গোফ কাটার পাত্র নন!
মামীকে দেখাতেই তিনি একটু হাসার চেষ্টা করলেন। 'ঐটা ছিল পাগলামী। প্রথম মিশনে যাবার খবর পেয়ে পাসপোর্ট করার সময় সে মোচ কেটে ছবি উঠায়। আমি অবশ্য নিষেদ করেছিলাম। কিন্তু বিদেশ যাবে সেই আনন্দে মোচ কেটে ফেলেছিল তোমার মামা। বিদেশে যাবে তাই চেহারা ভদ্র করার জন্যই নাকি মোচ কেটে ফেলার প্রয়োজন ছিল।'
তবে বোঝা যাচ্ছে তার 'ভদ্র' ভাবখানা তিনি বেশীদিন বজায় রাখেননি। অল্প দুএকটা ছবি পাওয়া গেল এলবামে। গোফ ছাড়া - মিশনে যাবার পরপরই তোলা। যে ছবিগুলো আমি কখনো দেখিনি। খুব সম্ভবতঃ তিনি অল্প কিছুদিন পরেই আবার গোঁফ রাখতে শুরু করেন।
পাসপোর্টের কথা উঠতেই আমি মামীর দিকে তাকিয়ে একটু আমতা আমতা করে জিজ্ঞেস করি 'মামার পাসপোর্টটাকি এখনো আছে?'
মামী আমার দিকে একমুহুর্ত তাকালেন। তারপর ভেতরের ঘর থেকে একটা বড় সাইজের খাম নিয়ে এলেন। 'এইটার মধ্যে সব আছে। শেষবার তোমার মামার সাথে এইটাও আসছিল।' কথা ভারী হয়ে এল মামীর - বুঝলাম মামার কফিনের সাথে সম্ভবতঃ এই খাম এসেছিল। তাই মনে পড়েছে মামীর। একটু খারাপই লাগল তাকে পুরোনো ঘটনা মনে করিয়ে দেবার জন্য।
মামার মৃত্যু পরবর্তী কাগজপত্র এগুলো। তার মিশন সংক্রান্ত অনেক ডকুমেন্টও পাওয়া গেল। আমি ভিতরের সবগুলো কাগজপত্র বের করে খুটিয়ে খুটিয়ে দেখলাম। তবে কোন রকম সন্দেহজন কিছু চোখে পড়ল না। একটা বিষয়ই একটু খটকা লাগল। পাসপোর্ট বা অফিসিয়াল সব কাগজপত্রে তিনি একটি মাত্র ছবিই ব্যবহার করেছেন। সেটি তার গোঁফবিহীন ছবি।
(চলবে...)
Subscribe to:
Post Comments (Atom)
No comments:
Post a Comment