Tuesday, September 2, 2008

ছায়া (পর্ব-১,২)

(জনাব মৃদুল আহমেদ কে উৎসর্গ করা হল। উনার দেয়া প্লটের ’ছায়া’ অবলম্বনে লিখলাম। ভুতের গল্প লেখার কথা ছিল; হচ্ছে কিনা জানিনা)
'স্যার, অনেক্ষন যাবৎ আপনার জন্য অপেক্ষা করছি। '- রুমে ঢুকতেই লোকটাকে দেখতে পান মৃদুল আহমেদ; ঘরের ঠিক মাঝে দাড়িয়ে আছে। জানালা দিয়ে শেষ বিকেলের রোদ এসে পড়েছে ঘরে। জানালা বরাবর দাড়িয়ে থাকা লোকটির ছায়া পড়েছে দ্বিগুন হয়ে। একাগ্রচিত্তে নিজের ছায়ার দিকে তাকিয়ে আছে সে।
'মোতালেব' - মৃদুল আহমেদ চিৎকার করে ডাকলেন। লোকটির মেকি আচরন গায়ে মাখলেন না। অনেকেই অদ্ভুত আচরন করে তার সাথে। বোঝাতে চায় তারা ব্যাতিক্রমী কিছু। কোন রকম সম্ভাষন বিহীনভাবে তার সাথে কথা শুরু করা এই লোকটিকেও সেই গোত্রের মনে হচ্ছে।
মোতালেব উকি দিল দরজায়। ইশারায় তাকে পর্দা টেনে দিতে বলেন মৃদুল আহমেদ। শেষ বিকেলের রোদ তার প্রিয় হলেও আজকের রোদ তার ভাল লাগছে না। আজ সারাটা দিন মাটি হয়েছে। গতপরশু ধানমন্ডীতে তার পরিচিত একজন ব্যবসায়ী হার্টএটাক করে মারা গেছেন। খুবই সাধারন একটা কেস। তদন্ত করে ডাক্তারী রিপোর্ট মোতাবেক তাই প্রমানিত হয়েছে। কিন্তু সমস্যা বাধিয়েছে সেই ছায়া। বাড়ির মালকিনের বক্তব্য সে ছায়াটাকে তার স্বামীর ঘরে যেতে দেখেছে। স্বামীর চিৎকার শুনে ঘরে গিয়ে দেখে স্বামী তার মরে পরে আছে। বাড়ির দারোয়ানও একই কথা বলেছে। সে নাকি ছায়াটাকে বাড়ির সদর দরজা দিয়ে ঢুকতে দেখেছে। সে এতই ভয় পেয়েছে যে সে চাকরীর মায়া ত্যাগ করে সে বাড়ি ছেড়ে ভেগেও গেছে।
সেদিন বাড়ির মালকিনের মরা কান্নার জন্য তার সঙ্গে এ ব্যাপরে কোন কথা বলেননি তিনি। আজ গিয়ে সারাটাদিন তাকে বোঝাতে গলদঘর্ম হয়েছেন। তাকে কোনভাবেই বোঝানো যায়নি যে তার স্বামীর স্বাভাবিক মৃত্যু ঘটেছে।
বেশ কিছুদিন যাবৎ এই ছায়ার উৎপাত শুরু হয়েছে ঢাকা শহরের কয়েকটি এলাকায়। এতদিন ছায়া দেখা, ভয় পাওয়া, চিৎকার চেঁচামেচী - এর মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল ঘটনা। কিন্তু ছায়াকে জড়িয়ে এই মৃত্যুর ঘটনায় মানুষের ভীতি আরও বেড়ে গিয়েছে।
এদিকে এটা নিয়ে পত্রিকাওলারাও বাড়াবাড়ি শুরু করেছে। বিশাল হেডিং দিয়ে নিউজ করেছে। 'ঢাকা শহরে এবার ছায়ার প্রথম শিকার'। 'ছায়ার আক্রমনে ব্যবসায়ীর মৃত্যু'। ইত্যাদি ইত্যাদি। আরে বাবা প্যানিক ছড়ানোর দরকারটা কি?
ফলাফল যা হবার তাই হয়েছে। কমবেশী সবাই এখন ছায়া দেখা শুরু করেছে। মৃদুল আহমেদের ধারনা এসবই তাদের অবচেতন মনের ভুল। যেমন সেদিন কে একজন রাতের বেলা তার নিজের ঘরে ঝোলানো কাপড় দেখে ছায়া ছায়া করে মুর্ছা গেছে। এই হচ্ছে অবস্থা।
মৃদুল আহমেদের সন্দেহ কিছু লোক এই সুযোগে প্রতারনা করার চেষ্টা করছে। মিরপুরে গতরাতে এক বাড়িতে ডাকাতি হয়েছে। সেখানেও নাকি লোকজন শুধু ছায়া দেখতে পেয়েছে। বাড়ির সিকিউরিটির লোক নাকি কয়েকটা ছায়া ঢুকতে দেখেছে। খুব সম্ভবতঃ কালো পোষাক পরে ঢুকেছিল দুর্বৃত্ত। ছায়ার ভয়েই লোকজন কিছু করার সাহস করেনি। নির্বিঘ্নে ডাকাতি সেরে গেছে ডাকাতেরা।
সবগুলো বিচ্ছিন্ন ঘটনা হলেও প্রতারক চক্রের পোয়াবারো হয়েছে।
'স্যার, অনেক্ষন যাবৎ আপনার জন্য অপেক্ষা করছি।' -লোকটি আবার বলে ওঠে। এবার অবশ্য ঘরের মাঝখানে নয়। তার ডেস্কের সামনের চেয়ারে বসে আছে সে।
'ওহ গড', লোকটিকে যে বসিয়ে রেখেছে তা মনেই নেই। ছায়ার ভাবনায় ডুবে গিয়ে লোকটির কথা ভুলেই গিয়েছিলেন তিনি। লোকটিকে বসিয়ে রাখার জন্য এখন একটু খারাপই লাগছে।-'আমি খুবই দুঃখিত; আপনাকে এতক্ষন বসিয়ে রাখার জন্য।' -একটু ভাল করে দেখলেন তিনি লোকটিকে। মাঝ বয়েসি লোক। চোখের নীচে কালশিটে দাগ। চেহারা দেখেই বোঝা যায় প্রচুর টেনশন করেন সবকিছুতেই। -'বলুন আপনার জন্য কি করতে পারি আমি।'
'আমি একটা সমস্যায় পড়েছি।'- ইতস্ততঃ করতে থাকে লোকটি।'হ্যা বলুন। আমার কাছে তো সমস্যা নিয়েই আসবেন। বলুন নিঃসংকোচে বলুন।''মানে আমি আমার ছায়া নিয়ে বেশ ঝামেলায় পড়ে গেছি।'এই কথা- মনে মনে একটু নিরাশ হন মৃদুল আহমেদ। ছায়া ছাড়া কি আর কোন কিছু দেখতে পাচ্ছে না নাকি লোকজন?'ও আচ্ছা। তাহলে আপনিও ছায়া দেখতে শুরু করেছেন। আপনি কোথায় থাকেন আর কিভাবে ছায়া দেখলেন ডিটেইলস বলুনতো?''না মানে- আমি আসলে ছায়া দেখে ভয় পাচ্ছি না।'- একটু থামে লোকটি। -'শ্যামলীতে আমার বাসা।''আর' - আবারো ইতস্তত করে লোকটি।- 'আপনি তো পত্রিকায় ছায়া দেখে ভয় পেয়ে মৃত্যুর খবরটি দেখেছেন তাইনা?''ব্যবসায়ী আকবর সাহেবের মৃত্যুর খবর?'-এইবার একটু আগ্রহী হন মৃদুল আহমেদ।- 'আপনি কি আকবর সাহেবের কেউ হন?''না আমি উনার কেউ না। আমি আসলে তাকে কোনদিন দেখিওনি চিনিওনা।''তাহলে?''আসলে- কিভাবে যে বলি। এতদিন বিষয়টা নিজেই সমাধানের চেষ্টা করছিলাম তাই কাউকে কিছু বলিনি। কিন্তু আকবর সাহেবের মৃত্যুর ঘটনার পর থেকে আমি অনুশোচনায় দগ্ধ হচ্ছি। আর আপনার সাথে আগেই দেখা করতে চেয়েছিলাম। কিন্তু পারিনি। ' - এক নিশ্বাসে কথাগুলো বলে ফেলে লোকটি।
'দেখুন এভাবে বললে তো আমি কিছু বুঝতে পারছি না। অযথা হেয়ালী না করে যা বলতে চান সরাসরি বলুন। আপনি কি আকবর সাহেবের মৃত্যুর সাথে জড়িত?''ঠিক তা নয়। তবে আকবর সাহেবের স্ত্রী এবং বাড়ির দারোয়ান যেকথা বলেছে তা সঠিক।''তার মানে?''মানে যে ছায়াটা ওরা দেখেছে ওটা সত্যিই একটা ছায়া।''ও'- চেয়ারে হেলান দিয়ে বসেন মৃদুল আহমেদ। তার আগ্রহ কমে যাচ্ছে। ছায়া দেখা যাচ্ছে লোকজনের মানসিক সমস্যারও সৃষ্টি করছে।'তারমানে আপনি বলতে চান ঢাকা শহরে যে ছায়ার উৎপাত শুরু হয়েছে সেগুলো সত্যিই ছায়া?''জি- আসলে তাই। ছায়াটা সত্যিই একটা মানুষের ছায়া।''তাহলে গতকাল যে ডাকাতিটা হল ওখানে অতগুলো ছায়া এল কিকরে?''সেটা অবশ্য আমি জানি না। ঐ ছায়াগুলোর ব্যাপারে সত্যিই আমি কিছু জানি না। ''তারমানে অন্ততঃ একটা ছায়ার ব্যাপারে আপনি জানেন বলতে চাচ্ছেন?''জি ঠিক তাই।''আপনি ছায়াটাকে চেনেন মনে হচেছ?''জি - ছায়াটাকে আমি চিনি।''তা আপনার এমন মনে হবার কারন?''কারন যে ছায়াটা নিয়ে এত হুলুস্থুল শুরু হয়েছে' - চোখ তুলে সরাসরি তাকাল সে মৃদুল আহমেদের দিকে - 'সে ছায়াটা আমার।'

***********

একটু চিন্তিত দেখাল আহমেদ সাহেবকে। লোকটিকে গুরুত্ব দিতেই হচ্ছে। ছায়ার সাথে তার সরাসরি সংশ্লিষ্টতা থাক বা না থাক; ব্যপারটা যে তাকে কোনভাবে ভোগাচ্ছে এতে কোন সন্দেহ নেই। লোকটির কথাবার্তায় তাই মনে হচ্ছে। আর কোন কারন ছাড়া লোকটি এতক্ষন বসে থাকতো না নিশ্চয়ই।
'আপনার বিশ্বাস হচ্ছে না তো? না হবারই কথা' - আহমেদ সাহেবের নীরবতা দেখে লোকটি আবার বলতে শুরু করে। -'প্রথম প্রথম আমিও ব্যাপারটা বিশ্বাস করতে পারতাম না - ভাবতাম আমি স্বপ্ন দেখছি অথবা সবই আমার মনের কল্পনা। কিন্তু আস্তে আস্তে সব বুঝতে পারলাম। ব্যপারটা আসলেই সত্যি - স্বপ্ন বা কল্পনা নয়। যেমন শেষ ঘটনাটাই বলি। আকবর সাহেবের বাসার ভিতর -'
ডান হাত ট্রাফিক পুলিশের মত উচু করে তুললেন আহমেদ সাহেব; লোকটিকে থামানোর জন্য। - 'থামুন মিস্টার..' -লোকটির নাম বলতে গিয়ে বুঝলেন সামনে বসা লোকটির নামটাই এখনো জানা হয়নি। সাধারনতঃ এরকম হয়না তার।'এই দেখুন আপনার নামটাই এখনো জানা হয়নি।''আমার নাম বোরহান। মোঃ বোরহান উদ্দিন।''বোরহান উদ্দিন।' - নীচুস্বরে একবার নামটা আওড়ালেন আহমেদ সাহেব। তারপর লোকটির দিকে তাকালেন। -'দেখুন, মিস্টার বোরহান - আপনি এভাবে বললে থাকলে আমি কিছুই বুঝতে পারব না। বরং বিষযটা আরো গোলমেলে লাগবে আমার কাছে। আমি আপনার কথা বিশ্বাস করছি। বুঝতে পারছি ঐ ছায়াটা আপনাই ছায়া। কিন্তু এ ব্যাপারে আপনাকে সাহায্য করতে আমাকে সবকিছু শুরু থেকে জানাতে হবে। সেকারনে আমি আপনাকে যা যা জিজ্ঞেস করব তার ঠিক ঠিক উত্তর দেবেন আশা করি।'
বোরহান নামের লোকটি সম্মতিসূচক মাথা নাড়াল।
'আপনি কি কাজ করেন?'
'একটা এন.জি.ও তে চাকুরী করি - নাম বন্ধু। শ্যমলীতেই আমার অফিস। বাসা থেকে মাত্র কয়েক মিনিটের পথ।' - লোকটির উত্তেজিত ভঙ্গি দেখে মনে হল আকবর সাহেবের ঘটনা না বলা পর্যন্ত স্বস্তি পাচ্ছে না সে।
'আপনার চেহারা দেখে মনে হচ্ছে আপনি অনেক রাত পর্যন্ত জেগে থাকেন। সত্যিই কি?'
'হ্যা ঠিক, আসলে গল্পের বই পড়ার নেশা রয়েছে আমার। অনেক রাত জেগে গল্পের বই পড়ে থাকি। ঘুমাতে ঘুমাতে রাত একটা দুটো বেজে যায়।'
'কি ধরনের বই আপনি সাধারনত পড়ে থাকেন?'
'সব ধরনের বইই পড়ি। তবে থ্রিলার, রহস্যোপন্যাস এগুলো আমার পছন্দের। ও হ্যা হরর বইও পড়ি মাঝে মাঝে। তবে যেদিন হরর বই পড়ি সেদিন রাতে ঘুমাতে পারি না। ভোরের দিকে যখন ফযরের আজান হয় তখন কিছুটা সাহস ফিরে আসে। তখনই ঘুমিয়ে পড়ি। '
'বাড়িতে আপনি একা তাইনা?'
'কি ভাবে বুঝলেন?'
'এমনি অনুমান করলাম। সংসারী মানুষ কখনো রাত জেগে গল্প পড়ার সময় পাবার কথা নয়।'
'তা ঠিক। একা বাসায় থাকি। সময় কাটতে চায় না। তাছাড়া ঘুমও সহজে আসে না তাই.. - ও হ্যা, ইদানীং রাতে পত্রিকাও পড়ি। ছায়া সংক্রান্ত ঘটনা কি ছাপা হল তা পড়ি খুটিয়ে খুটিয়ে।'
'ও আচ্ছা। তা, এই বাসায় আপনি কতদিন যাবৎ আছেন?'
'তা প্রায় চার বছর হয়ে গেছে। বিয়ের পর থেকেই এই বাসায় আমার বসবাস।'
'বিয়ের পর থেকে?' - একটু অবাক হলেন আহমেদ সাহেব। তিনি লোকটিকে অবিবাহিত মেসের বাসিন্দা ভেবেছিলেন।'আপনার স্ত্রীকোথায়?'
লোকটিও মনে হল একটু থতমত খেয়ে গেছে। বিয়ের ব্যপারটা প্রকাশ হয়ে যাওয়াতে। বেশ কয়েক মুহুর্ত নীরব থেকে উত্তর দিল বোরহান -'সে চলে গেছে।'
'চলে গেছে মানে?'
'মানে ওর সাথে আমার সম্পর্ক নাই। প্রায় বছরখানেক হল ওর সাথে আমার ছাড়াছাড়ি হয়ে গেছে। ছাড়াছাড়িটা অবশ্য ওই করিয়েছে। তারপর থেকে আমি বাসায় একাই থাকি।'
'আচ্ছা স্যরি। আর ব্যক্তিগত বিষয়ে জিজ্ঞেস করার জন্য দুখিত। তবে বুঝেনইতো, আপনার ছায়া সমস্যা সমাধানের জন্য আমার সবকিছুই জানা দরকার। '
'না, না, কোন অসুবিধা নেই।' - লোকটি প্রবল বেগে মাথা নাড়াতে থাকল। আমি অবশ্যই সবকিছু বলব আপনাকে।
'আচ্ছা - আপনিতো জানেনই, ঢাকা শহরে যে ছায়া বা ছায়াগুলোর উতপাত শুরু হয়েছে সেগুলো শুধু রাতের বেলায়ই বের হয়। এ ব্যাপারে আপনি কি বলেন। আপনার ছায়াও কি শুধু রাতের বেলা বের হয়?' - আহমেদ সাহেব প্রশ্ন করেন।
'ঠিক তাই। আমি রাতে ঘুমিয়ে যাবার পরই ছায়াটা আমার থেকে আলাদা হয়ে যায়; আর আমার আত্মাও একই সাথে আলাদা হয়ে ঐ ছায়ার ভেতর ঢুকে যায়। ছায়াটাই হয়ে যাই আমি। '
'দিনের বেলায় কখনো এরকম হয়নি?'
'না, দিনের বেলায় কখনো এ ঘটনা ঘটেনি। এমনকি দিনে ঘুমালেও এটা ঘটে না। '
'যাই হোক, আপনি বলতে চাচ্ছেন আপনার নিজস্ব স্বত্ত্বাও আপনার ছায়ার সাথে চলাফেরা করে এবং তা শুধু রাতের বেলায় - এইতো?'
'স্বত্ত্বা বলতে আমার আত্মাকে বোঝাচ্ছেন তো?' - আহমেদ সাহেব মাথা নেড়ে সায় দিলেন লোকটির প্রশ্নে।
সম্মতি পেয়ে আবার শুরু করল বোরহান -'হ্যা, আমি তাই মনে করি; আমার আত্মাও আমার ছায়ার সাথে চলাফেরা করে। আসলে আমার সাথে ঐ ছায়ার কোন পার্থক্য নেই। দিনের বেলা যেমন আমি মানুষ। রাতের বেলা আমি ছায়া-মানুষ। পার্থক্য এটুকুই - দিনে আমি রক্তমাংশের মানুষ আর রাতে ছায়া। তবে যেহেতু ওটা শুধুই আমার ছায়া তাই ছায়ামানব হিসাবে শারীরিক কোন ক্ষমতা আমার থাকেনা। আমার ইচ্ছা শক্তির উপর নির্ভর করে ওটার নড়াচড়া, চলাফেরা। যেমন সেদিন - বলতে গিয়েও আহমেদ সাহেবের দিকে তাকিয়ে থেমে গেল বোরহান। '
মুচকি হাসলেন আহমেদ সাহেব। লোকটি ঘটনাটা না বলা পর্যন্ত তার উত্তেজনা কমবে না মনে হচ্ছে। - 'ঠিক আছে আপনি বলে যান।'
'আসলে ঘটনাটা না বললে আমি স্বস্তি পাচ্ছি না। আকবর সাহেবের মৃত্যুতে আমার বিন্দুমাত্র দোষ নেই মনে করি। আমি শুধু তাকে ভয় দেখাতে চেয়েছিলাম। কিন্তু উনি যে মরে যাবেন তা ভাবিনি। আপনাকে তো আগেই বলেছি। উনি মারা যাবার পর আমার অনুশোচনা হচ্ছে। তাই এখন আর এই ছায়া ছায়া খেলা খেলতে ইচ্ছে করছে না। কিন্তু আমি বন্ধও করতে পারছি না। তাই আপনার সাহায্য চাইছি।'
'না ঠিক আছে। আমি এমনিতেও ঘটনাটা আপনার মুখ থেকে শুনতাম একটু পরে। আপনি সংক্ষেপে বলে ফেলুন।'
'ঠিক আছে আমি সংক্ষেপেই বলি। আমি আকবর সাহেবের বেডরুমের দরজার নিচ দিয়ে ঢুকে পড়ি। ভেতরে স্বামী স্ত্রী দুজন বিছানায় বসে টিভি দেখছিল। আমি ঢুকেছি তারা বুঝেননি। তারা একমনে টিভির দিকে তাকিয়েছিল আর' - একটু থামল বোরহান।
'আর ? আর কি?' - আহমেদ সাহেবের মনে হল কিছু একটা লুকানোর চেষ্টা করছে লোকটি।
'মানে সেজন্যই ওরা আমাকে দেখতে পেল না। শেষে আমি ওদের সামনে গেলাম। ওদের টিভির ডানদিকের দেয়ালে ওরা আমাকে দেখতে পেল। আমি দু হাত উচু করে ভয় দেখানোর ভাব করলাম। আকবর সাহেব - ওটা কি? ওটা কি? - বলে চিৎকার দিয়ে বিছান থেকে লাফিয়ে উঠে দাড়ালেন। কিসের ছায়া সেটা পরীক্ষা করার জন্য দুবার পেছনে তাকালেন। কিছু না দেখে চিৎকার দিয়ে বুকে হাত দিয়ে বসে পড়লেন। তার স্ত্রীও একই ভাবে আমাকে দেখে দেখে বিকট চিৎকার দিলেন। আমি দ্রুত বের হয়ে চলে এলাম। '
'বের হয়ে চলে এলেন?'
'হ্যা তাই। এবার আপনিই বলুন আমার কি দোষ এর মধ্যে?'
'না, ঠিক আছে। আমি আপনার কোন দোষ দেখছি না এর মধ্যে। কিন্তু এত লোক থাকতে আপনি কেন আকবর সাহেবের ঘরে গেলেন? আপনি থাকেন শ্যামলীতে। কাউকে ভয় দেখাতে শ্যামলী থেকে ধানমন্ডী পর্যন্ত যেতে হল কেন আপনাকে? আশেপাশের যে কোন বাড়িতে গেলেই তো হত - তাইনা?'
'আসলে' - একটু ইতস্ততঃ করল বোরহান। -'সত্যি কথা হচ্ছে আকবর সাহেবের সাথে আমার পরিচয় হয়েছিল। আমার এক দুঃসম্পর্কের আত্মীয়ের মাধ্যমে তার বাসায় গিয়েছিলাম। চাকুরী সংক্রান্ত ব্যপারে। মৌখিক পরীক্ষার আগেরদিন। তিনিও প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন যে আমাকে চাকুরীটা দেবেন। অথচ চাকুরীটা আমার হয়নি; একটা মেয়েকে দেয়া হয় চাকুরীটা। যেদিন এ খবরটা জানতে পারি সেদিনই মনে মনে ঠিক করি তাকে ভয় দেখাব। কিন্তু ভয় দেখানোতে যে উনি মারা যাবেন তা ঘুনাক্ষরেও চিন্তা করিনি।'
'তাই নাকি? কিছুক্ষন আগেও আপনি বলছিলেন আপনি তাকে কোনদিন দেখেননি আর চিনেনও না। '
'আসলে আমি ভয় পেয়েছিলাম। যদি আকবর সাহেবের মৃত্যুর জন্য আমাকে দায়ি করা হয়। কিন্তু সেটা তো সম্ভব নয় তাই না। আমি তো আর নিজে ভয় দেখিয়ে তাকে মেরে ফেলিনি। ভয় দেখিয়েছে আমার ছায়া। দোষী সাব্যস্ত হলে আমার ছায়াই হবে তাইনা। '
'দেখুন আপনার ভয় পাওয়ার কোন কারন নেই। ' - আহমেদ সাহেব আশ্বস্ত করেন বোরহানকে। -'আপনাকে তো বলেছিই; এতে আপনার কোন দোষ নেই। এ পর্যন্ত এই পৃথিবীতে অপরাধের জন্য কোন ছায়াকে শাস্তি দেয়া হয়নি। কোনরকম শাস্তিও বিধানও তৈরী হয়নি। অতএব আপনি নিশ্চিত থাকুন। এবং কোনকিছু না লুকিয়ে সবকিছু খুলে বলুন। এতে সমস্যাটার দ্রুত সমাধান হয়ে যাবে। '
'ঠিক আছে। আর কিছু লুকাব না। '
'আপনি কবে জানতে পারেন যে আপনার চাকুরী হয়নি?'
'এইতো গত সপ্তাহে। '
'তাহলে এতদিন তাকে ভয় দেখাননি কেন? আপনার তো উচিৎ ছিল সেদিনই রাতে তার বাড়ি গিয়ে হুমহাম করে ভয় দেখিয়ে আসা তাইনা?'
'বুঝছি আপনি আমার কথা বিশ্বাস করতে পারছেন না। যাই হোক, সেদিন রাতেই যাইনি কারন সেদিন আমার ছায়ামানবের কর্মকান্ড হয় নি। মানে - ছায়াটা সেদিন রাতে জেগে উঠেনি।'
'তারমানে আপনার ছায়া প্রতি রাতে জেগে উঠে না?'
'না' - ডানে বায়ে মাথা দোলায় বোরহান।
'কেন বলতে পারেন?'
'সেটা আমি জানিনা। সত্যিই জানিনা।'
আহমেদ সাহেব ঘড়ি দেখলেন। সন্ধ্যা হয়ে গেছে। -'আমরা আজ থামব এখানেই। আপনার ছায়ার ব্যাপারে কয়েকটা ব্যাপার পরিষ্কার হয়েছে আমার কাছে। আবার প্রশ্নও তৈরী হয়েছে কয়েকটি। সে ব্যাপারে পরে আলাপ করব ঠিক আছে?'
'তাহলে আমি কি আজ ?' - চেয়ার ছেড়ে উঠতে শুরু করে বোরহান।
আবার হাত তুলে থামালেন ওকে আহমেদ সাহেব; ইশারায় আবার বসালেন। -'আমি আজ রাতে একটা পরীক্ষা করতে চাই। যদি আপনার আপত্তি না থাকে। আমি আপনার ছায়াটার কর্মকান্ড দেখতে চাচ্ছি। আপনার কোন অসুবিধা না হলে আজ আপনি আমার সাথে থেকে যান।'
'তা কিকরে হয়। আপনার অসুবিধা হবে। '
'দেখুন অসুবিধাটা এখানে বড় ব্যাপার নয়। তাছাড়া বাড়িতে আমি ছাড়া কেউ নেই আজ। ছায়ার ব্যাপারটা সত্য ধরে নিলে তা প্রমান করাটাই যুক্তিযুক্ত হবে তাই না?'
'আপনি চাইলে থাকব। আমার কোন অসুবিধা হবে না। কিন্তু ছায়াটা বের না হলে কিন্তু আপনাকে নিরাশ হতে হবে।'
'তাতে অসুবিধা নেই। দেখি না কি হয় - আশা করতে দোষ কি? তবে আপনি কিন্তু ছায়া হয়ে আমাকে ভয় দেখাবেন না। শেষে ভযে আমি মরে গেলে কিন্তু বিরাট ঝামেলা হয়ে যাবে। '
আহমেদ সাহেব শব্দ করে হাসলেন। তিনি মোটামুটি নিশ্চিত ছায়ার ব্যাপারটি বোরহান নামক এই লোকটির মনের কল্পনা। ছায়ার নিজস্ব কোন সত্ত্বা থাকতে পারে না। ছায়া সংক্রান্ত ঘটনাগুলোর প্রতিটাই তার মনে গেথে যায়। যে কারনে সে ঘনটাগুলো নিয়ে ইচ্ছেমত স্বপ্ন দেখতে থাকে।
আকবর সাহেবের মৃত্যু নিয়ে দেয়া তার বক্তব্যও আকবর সাহেবের স্ত্রীর বক্তব্যের সাথে মেলে না। আকবর সাহেবের স্ত্রীর ভাষ্য অনুযায়ী সে লোকটিকে তার স্বামীর ঘরে যেতে দেখেছে। অথচ বোরহান বলছে সে দুজনকেই বিছানায় বসে টিভি দেখতে দেখেছে। এ থেকেই বোঝা যায় বোরহান ঘটনাটা নিজের মনে বানিয়েছে। এখন তার মাথা থেকে ছায়ার ভুত দুর করার জন্য তাকে বিশ্বাস করাতে হবে যে সেটি শুধুই তার তার মনের কল্পনা।
তবে একটা ব্যাপার হঠাৎ মনে পড়ে যায় তার - যেটা জিজ্ঞেস করতে গিয়েও করা হয়নি - ঐ ঘটনাটা বলার সময় কিছু একটা লুকিয়েছে বোরহান। ব্যাপারটা পরে জানতে হবে। তিনি আজ ক্লান্ত।
আহমেদ সাহেব গলা উঁচু করে মোতালেব কে ডাকলেন।

No comments: