Tuesday, September 2, 2008

আমি দ্বিপৃর বাবা বলছি

(বি.দ্র.: একান্তই নিজের সুখ দুঃখ নিয়ে এই লেখা)
আজ আমার প্রথম সন্তানের ৫ম জন্মদিন। ২০০২ সালের এই দিনে বেলা ১১ টায় আমার ছেলের জন্ম। আমি তখন বগুড়ায়। যমুনার পাড়ের কোন এক গ্রামে বন্যার্ত মানুষের মাঝে ত্রানসামগ্রী বিতরনের কাজে ব্যস্ত। দীর্ঘ লাইনে দাড়িয়ে দরিদ্র মানুষগুলো। ডিস্ট্রিবিউশন টিমের লিডার হিসাবে এপাশ ওপাশ দৌড়াচ্ছি; কখনো নিজেই ত্রান সামগ্রী উঠিয়ে দিচ্ছি মানুষের হাতে। বেলা ২টার মত হবে - তখন খবরটা পাই আমি। ঢাকায় আসতে আসতে সন্ধা হয়ে যায়।
সেদিন আমার স্ত্রী তার অফিসে যাবার প্রস্তুতি নিচ্ছিল। এ সময় তার শারীরিক সমস্যা শুরু হয়। ওকে তাড়াতাড়ি মনোয়ারা হসপিটালে নিয়ে যাওয়া হয়। বেলা এগারটার সময় প্রথম সন্তানের আগমন এই পৃথিবীতে। প্রত্যাশিত দিনের ৪ সপ্তাহ আগেই জন্ম হয় ওর। আমি জানিনা কোথায় সমস্যা ছিল, কেন সমস্যা হয়েছিল; শুধু এটুকু জানি জন্মগতভাবে আমার ছেলেটার মাথায় ছোট্ট একটা সিস্ট হয়। যার কারনে একটা নির্দিষ্ট সময় পর পর সবসময় তার খিঁচুনী হত। খিচুনীর চরম পর্যায়ে হাসপাতাল। কমে গেলে বাসায়। বাড়লে আবার হাসপাতাল। এভাবেই চলছিল তার জীবন। তবে সুস্থ থাকাকালীন সময়ে কখনোই মনে হত না ও যে অসুস্থ। তার অসুস্থতাকালীন সময়ে মোট দু’বার রক্তের প্রয়োজন হয়। ওর মামা দুবারই ওকে রক্ত দেয়। ওর মামা না থাকলে আমাকে রক্তের সন্ধানে দৌড়াতে হত নিশ্চয়ই।
খিচুনীর সময়গুলোতে ও যখন হাসপাতালে কষ্ট পেত তখন আমি বউকে স্বান্তনা দিতাম। সবাই আমার নির্লিপ্ত মুখ দেখতে পেত। আর আমি সবার অগোচরে রাস্তায় নেমে জোরে জোরে অথচ নিঃশব্দে কাঁদতাম। কেঁদে কেঁদে যখন ভিতরটা হাল্কা হত তখন আবার নির্লিপ্ত মুখে ফিরে যেতাম। অনেকেই আমার নির্লিপ্ততা দেখে অবাক হত। প্রতিবারই আমি মনে মনে সৃষ্টিকর্তার কাছে শক্ত শপথ নিতাম; আমার ছেলের কিছু হলে সব ধংস করে ফেলব। চুরমার করে ফেলব চারিদিক। তারপর সাময়িক সুস্থ হলে ছেলেকে নিয়ে বিজয়ীর বেশে বাসায় ফিরতাম।
যাই হোক, বেশী কথা বাড়াব না। ধীরে ধীরে আলোচনা করে সহানুভুতি আদায় করার মত হয়ে যাচ্ছে বিষয়টা। যা বলতে চাই তা হচ্ছে - আমার ছেলেটা মারা গেছে প্রায় তিন বছর বয়সে (৩৪ দিন কম)। এই তিন বছর জীবনে ছেলেটা প্রচন্ড কষ্ট পেয়েছে। ওর জীবনের বড় একটা সময় কেটেছে সেন্ট্রাল হাসপাতালে (ধানমন্ডী, ঢাকা)। শেষ সময়টুকুও ঐ হাসপাতালেই।
সৃষ্টিকর্তা ভালই খেলেছিলেন আমার সাথে। সন্তানের মৃত্যুর পর খুব বেশীদিন লাগেনি তাকে ভুলে যেতে। সেই শক্ত শপথের কথাও মনে রাখিনি। আবার দৈনিন্দিন জীবন যাপনে ব্যস্ত হয়ে পড়েছি। যদিও মাঝে মাঝেই আমরা দুজন একসঙ্গে কাঁদতাম। তবে যে মাসে আমার ছেলে মারা যায় তার পরের মাসেই আমি বাসা বদল করে ফেলেছিলাম। আবার নতুন করে সব কিছু শুরু করার প্রত্যয়ে। নতুন বাসায় জন্ম হয় আমার মেয়ের - আমার দ্বিতীয় পৃথিবীর।
এরই মধ্যে আমার মেয়ের বয়স দুই বছর পার হয়ে গেছে। আমি আবারো বাসা বদল করে আমার অফিসের কাছাকাছি চলে এসেছি। কারন একটাই। আমার মেয়ে। প্রতিদিন দুপুরে বাসায় যাই। খাই আর তার সঙ্গে কিছুক্ষন সময় কাটাই। এভাবেই চলছে আমার জীবন। তবে ইদানীং একটু ঝামেলা হচ্ছে। মাসখানেক আগেও মেয়েকে ভুলিয়ে ভালিয়ে রেখে আসতে পারতাম। আমার পিছু নিলেই ওকে বলতাম 'আববু, বলতো তোমার জন্য কি আনব?' ও তখন মাথা নাড়িয়ে উত্তর দিত 'দুছ (জুস) আর চিপ' তারপর 'টাটা বাইবাই' বলে বিদায় জানাত। এখন আর ওভাবে বিদায় দেয় না। আমাকে দেখতে না পেলেই ’আব্বু নাই আব্বু নাই’ বলে কান্না জুড়ে দেয়। আর বের হবার সময় 'আমি আমি' 'আমি হাইট্টা' বলে নিজের জুতোজোড়া পরে আমার পিছু নেয়। অর্থ্যাৎ আমার সাথে হাটতে বের হবে। এ কারনে গত কয়েকদিন যাবৎ নতুন পথ বেছে নিতে হয়েছে। ওর মা ওকে ভুলিয়ে ভালিয়ে রাখে দুরে সরিয়ে নিয়ে যায়। আমি চুপ করে পালিয়ে আসি।
মেয়েটাই এখন আমার সব। প্রতিদিনই আমার সুখ দুখ হাসির মাঝে আমার মেয়ে। ছেলের কথা আমার এখন ভুলেও মনে পড়েনা। গত তিন বছরে অনেকবারই গ্রামের বাড়িতে গিয়েছি। কিন্তু কখনো যাইনি আমার ছেলের কবরের কাছে। আমার ছেলের নাম রাওয়াদ। আমি আদর করে ডাকি ভুটু। আমার দ্বিতীয় পৃথিবী ছিল সে। তাই ভুটু। আমি ছিলাম ভুটুর বাবা। আমার স্ত্রীও আমাকে মাঝে মধ্যে ওভাবে ডাকত। ভুটু চলে যাবার পর আমার দ্বিতীয় পৃথিবী হারিয়ে ছিল কিছুদিন। দুবছর আগে আমি আবার আমার দ্বিতীয় পৃথিবী ফিরে পেয়েছি। আমার দ্বিতীয় পৃথিবী আমার মেয়ে - দ্বিপৃ। ওটাই ওর নাম। এখন আমি দ্বিতীয় পৃথিবীর পিতা। দ্বিপৃর বাবা।
পুনশ্চ: আমি তৃতীয় পৃথিবীর অপেক্ষায় আছি। দুমাস পরে ওর মাটির পৃথিবীতে আসার কথা রয়েছে। ও এখন অদ্ভুত এক জগতে বাস করে। ভাবলেই অবাক হই - আমি তিন ভুবনের তিন সন্তানের পিতা! আমার মত ভাগ্যবান এ সময়ে আর কি কেউ আছে?

No comments: