Monday, September 22, 2008

আকাশ পথের প্যাচালি:

আপাততঃ গন্তব্য সিঙ্গাপুর। তারপর ঢাকার ফ্লাইট। বেছে বেছে ইমার্জেন্সী এক্সিটের পাশের সিট নিয়েছি। বিপদ দেখলে যাতে মৃত্যুর সাথে ফাইট দিয়ে পগার পার হতে পারি। পাশের সীটে এক সাদা চামড়া। আসলেই কেউকেটা জাতীয় কিছু - নাকি শুধুই ভাব বুঝতে পারছি না। ল্যাপটপে মনোযোগ দিয়ে কি সব হিসাব করছে। শালা ভাউড়া কি আমাকে দেখানোর জন্য লক্ষ লক্ষ ডলারের হিসাব করছ? আমি আড়চোখে দেখলাম দু’একবার। ব্যাটায় খুব বড় কিছু হলে অবশ্য ব্রাক্ষ্মনদের এলাকায় বসত। এই এলাকায় আমার চোখে তাকে ঠিক ব্রাহ্মন মনে হচ্ছে না। এই এক সমস্যা। যেখানেই যাই - ব্রাহ্মন আর শুদ্রগোত্রের জন্য আলাদা ব্যবস্থা দেখি। আর আমি শালা বরাবরই শুদ্র গোত্রীয়। মনে আছে জীবনের প্রথম যেবার বিমানে উঠি সেবার খুব ভাব নিয়ে বিমানের ভেতর ঢুকলাম। সামনেই খালি সিটগুলো দেখে মাথা চক্কর দিয়ে উঠল। এই না হলে বিমান! বউ নিয়ে আরামসে ঘুমানো যাবে এরকম সাইজের সিট। এক্কেবারে বিছানা যেন এক একটা। মোটামুটি লাফ দিয়ে জানালার পাশে পছন্দসই একটা খালি সিটে ঝপাং মারলাম। সাথে সাথেই কোত্থেকে যেন সুন্দরী ডাইনী রুপে আমার সামনে উদয় হল। 'ক্যান আই সী ইউর পাস প্লিজ?'লে হালুয়া। বসতে না বসতেই আবার টিকিট চায় দেখি। ঢুকার সময় তো একবার দেখালাম। বিমান তো ছাড়লই থুড়ি উড়লই না।এ যাবৎ আমার দৌড় ’এ জার্নি বাই বাস’ পর্যন্ত সীমাবদ্ধ ছিল। আর বাস না ছাড়ার আগে জীবনে কখনো টিকিট দিয়েছি বলে মনে পড়ে না। বাসে কোন এক বিচিত্র কারনে থেমে থাকা অবস্থায় কখনোই ভাড়া বা টিকিট দেওয়ার রেওয়াজ নেই। বাসের কন্টাকটারও গাড়ি থেমে গেলে ভাড়া তোলা বন্ধ রাখে। যাই হোক, এটা তো আর বাস না - এদের নিয়ম কানুনও নিশ্চয়ই আলাদা। আমি টিকিট বার করে তার হাতে দিলাম। সে কি কি জানি বলল বুঝলাম না - আমি হ্যাবলার মত তাকিয়ে থাকলাম। সে আমাকে ইশারা করে উঠে তার পেছন পেছন যেতে বলল। আমি উঠে তার পিছু পিছু যেতে থাকলাম। সে আমাকে বিমানের লেজের কাছে এক্কেবারে পিছনের সিটে বসিয়ে দিয়ে চলে গেল। বলল এটাই নাকি আমার সীট!জীবনে খুব কম সময় পিছনের সিটে বসেছি। মনে পড়ে ছোট বেলায় একবার পিকনিকে যাবার সময় কপালে বাসের এক্কেবারে পেছনের সীটে স্থান হওয়ায় রীতিমতো কেঁদে দিয়েছিলাম। পরে বড় ভাইদের মধ্যস্থতায় সামনের দিকে বসার সৌভাগ্য হয়। সেইরকম মন খারাপ হতে লাগল। জীবনের প্রথম বিমান ভ্রমন তাও আবার পেছনের সীটে। আশেপাশের যাত্রীদের চেহারা দেখে মন আরও খারাপ হয়ে গেল। মহাখালী থেকে বগুড়ার বাসে উঠেছি যেন। চারিদিকে মফিজ আর মফিজ। অথচ এই আমি কি ভেবেছিলাম। যাই হোক; সে অনেকদিন আগের কথা। এরই মধ্যে আমি নিজেই মফিজ সেজে বেশ কয়েক ট্রিপ মেরে দিয়েছি - মফিজ ক্লাশের যাত্রী হিসেবে। অর্থ্যাৎ ইকোনোমি ক্লাশে। তবুও ভাল যে অফিসের দয়ায় বারকয়েক উড়তে পেরেছি। নিজের টাকার বিমান বন্দর পর্যন্ত যেতে সাহস হয় না আমার। যা বলছিলাম; আজকে আমার এই সহযাত্রী সাদা চামড়ার হিসাব নিকাশ করার ব্যাপারটা সত্যিও হতে পারে। খামোখাই ওকে দোষ দিয়ে লাভ কি। আমারই মনে হয় ’চোরের মন পুলিশ পুলিশ ভাব’। ওকে মাথা থেকে আপাততঃ ঝেড়ে ফেলে সীটের হ্যান্ডেল থেকে (রিমোট??) কন্ট্রোলটা বের করলাম। নিজেকে বড় কিছু প্রমান করার চেষ্টা না করলেও বড় বিটল প্রমান করতে ইংরেজী মুভির ’ভাল সিন’ গুলো টেনে টেনে দেখতে লাগলাম। ...........’হাই’ - দেখি ব্যাটা কাজকর্ম শেষ করে আমার দিকে মুচকি হাসি দিয়ে অপেক্ষা করছে। ’হ্যালো’, ’শালা ভাউড়া’ - আমিও বিগলিত হাসি উপহার দিলাম। পরের শব্দদুটো অবশ্য মনে মনে বললাম। ’হয়ার আর ইউ ফ্রম?’’আই এ্যাম ফ্রম বাংলাদেশ’ - বলেই অস্বস্তিতে পড়লাম। ব্যাটায় কি আমি কোন দেশের লোক তা বুঝাইল নাকি কোথা থেকে আইলাম তা বুঝাইল? আই সি, হোয়াট ডু ইউ ডু?’আই এম এ ফুড সিকিউরিটি ম্যানেজার।’ - বসের পদবী অবলিলায় নিজের বলে চালিয়ে দিলাম। ভাউড়ামি কি আমি জানিনা! হাতের যন্ত্রটা আবার যথাস্থানে ফেরত পাঠিয়ে একটা 'চাপা'যুদ্ধের জন্য মনে মনে প্রস্তুতি নিলাম। ’ফুড সিকিউরিটি?’ - তার ভ্র'কুটি দেখেই বুঝলাম ভুল যায়গায় ভুল শব্দ ব্যবহার করে ফেলেছি। ফুড সিকিউরিটির ব্যাপারটা ডেভলাপমেন্ট ফিল্ডের লোক যারা তৃতীয় বিশ্বের দরিদ্র অঞ্চল গুলোতে কাজ করে তারা ছাড়া আর কেউ সহজে বোঝার কথা না। জাপানী ট্রেইনারের কথা মনে পড়ল। ট্রেনিং ক্লাশে সে একটা জোক বলেছিল। সব ট্রেইনাররাই অবশ্য এরকম কিছু জোক স্টকে রাখে। ট্রেনিং ক্লাশে নিজের বলে চালিয়ে দেয়। আমার স্টকেও এরকম কিছু রাখি। যখন ট্রেনিং ফ্রেনিং করাই তখন আমিও এ রকম রেডি স্টকের কিছু কৌতুক নিজের বলে চালিয়ে দেই। এটা অবশ্য অন্যায় কিছু না। পার্টিসিপেন্টদের একটু আনন্দ দেয়া আর ট্রেনিং ক্লাশের একঘেয়েমি দুর করতে এটা সাহায্য করে। যাই হোক, কে একজন জাপানী ট্রেইনারের পরিচয় জানতে চাইলে সে বলেছিল যে সে ফুড সিকিউরিটি নিয়ে কাজ করে। ফলে লোকটি তাকে রেফ্রিজারেটর ব্যাবসায়ী মনে করেছিল।এই ব্যাটা অবশ্য তাৎক্ষনিক ভাবে ফুড সিকিউরিটিকে রেফ্রিজারেটর এর ব্যবসা মনে করলনা। 'হোয়াট কাইন্ড অব ফুড সিকিউরিটি?' - আমার নিরবতায় সে আবার প্রশ্ন করল। আমি যথাসম্ভব বোঝানোর চেষ্টা করলামঃ দরিদ্র দেশের মানুষ যাতে সারা বছরে কোন সময় খাবারের অভাবে না পড়ে; সময়মত যাতে খাদ্য পাওয়া যায় এবং সেই সাথে মানুষগুলো প্রয়োজনের সময় খাদ্য কিনে খাবার ক্ষমতা থাকে সে বিষয়টাই হচ্ছে ফুড সিকিউরিটি। ভাউড়া মনে হয় কিছুক্ষন চিন্তা করল। তারপর হঠাৎ - ’আই গট ইউর বিজনেস’ - বলে বিজ্ঞের মত মাথা উপর নীচ করতে লাগল। আমি ঠোট উল্টে চোখ বড় বড় করে তাকালাম তার দিকে যেন তার এই অবারিত জ্ঞানে আমি যারপরনাই স্তম্ভিতঃ।”ইউ আর ইন কোল্ড স্টোরেজ বিজনেস, রাইট?” ’ইয়েস ইয়েস ইউ আর কারেক্ট।’ - আমি অতি বিষ্ময়ে বিষ্মিত এরকম ভাব করে ভয়াবহভাবে তেপ্প্ন্নাবার মাথা উপরে নীচে ঝাকালাম। তারপর আবার রিমোট কন্ট্রোলটি টেনে বের করলাম।এই মাথা মোটার সাথে ফুড সিকিউরিটি নিয়ে আলাপ করার চেয়ে ক্রিস ওয়ার্ল্ডেও মুভি গুলোর ’ভালসিনগুলো’ রিওয়াইন্ড ফরওয়ার্ড করে মুখস্ত করা ঢের ভাল।