Monday, September 22, 2008

আকাশ পথের প্যাচালি:

আপাততঃ গন্তব্য সিঙ্গাপুর। তারপর ঢাকার ফ্লাইট। বেছে বেছে ইমার্জেন্সী এক্সিটের পাশের সিট নিয়েছি। বিপদ দেখলে যাতে মৃত্যুর সাথে ফাইট দিয়ে পগার পার হতে পারি। পাশের সীটে এক সাদা চামড়া। আসলেই কেউকেটা জাতীয় কিছু - নাকি শুধুই ভাব বুঝতে পারছি না। ল্যাপটপে মনোযোগ দিয়ে কি সব হিসাব করছে। শালা ভাউড়া কি আমাকে দেখানোর জন্য লক্ষ লক্ষ ডলারের হিসাব করছ? আমি আড়চোখে দেখলাম দু’একবার। ব্যাটায় খুব বড় কিছু হলে অবশ্য ব্রাক্ষ্মনদের এলাকায় বসত। এই এলাকায় আমার চোখে তাকে ঠিক ব্রাহ্মন মনে হচ্ছে না। এই এক সমস্যা। যেখানেই যাই - ব্রাহ্মন আর শুদ্রগোত্রের জন্য আলাদা ব্যবস্থা দেখি। আর আমি শালা বরাবরই শুদ্র গোত্রীয়। মনে আছে জীবনের প্রথম যেবার বিমানে উঠি সেবার খুব ভাব নিয়ে বিমানের ভেতর ঢুকলাম। সামনেই খালি সিটগুলো দেখে মাথা চক্কর দিয়ে উঠল। এই না হলে বিমান! বউ নিয়ে আরামসে ঘুমানো যাবে এরকম সাইজের সিট। এক্কেবারে বিছানা যেন এক একটা। মোটামুটি লাফ দিয়ে জানালার পাশে পছন্দসই একটা খালি সিটে ঝপাং মারলাম। সাথে সাথেই কোত্থেকে যেন সুন্দরী ডাইনী রুপে আমার সামনে উদয় হল। 'ক্যান আই সী ইউর পাস প্লিজ?'লে হালুয়া। বসতে না বসতেই আবার টিকিট চায় দেখি। ঢুকার সময় তো একবার দেখালাম। বিমান তো ছাড়লই থুড়ি উড়লই না।এ যাবৎ আমার দৌড় ’এ জার্নি বাই বাস’ পর্যন্ত সীমাবদ্ধ ছিল। আর বাস না ছাড়ার আগে জীবনে কখনো টিকিট দিয়েছি বলে মনে পড়ে না। বাসে কোন এক বিচিত্র কারনে থেমে থাকা অবস্থায় কখনোই ভাড়া বা টিকিট দেওয়ার রেওয়াজ নেই। বাসের কন্টাকটারও গাড়ি থেমে গেলে ভাড়া তোলা বন্ধ রাখে। যাই হোক, এটা তো আর বাস না - এদের নিয়ম কানুনও নিশ্চয়ই আলাদা। আমি টিকিট বার করে তার হাতে দিলাম। সে কি কি জানি বলল বুঝলাম না - আমি হ্যাবলার মত তাকিয়ে থাকলাম। সে আমাকে ইশারা করে উঠে তার পেছন পেছন যেতে বলল। আমি উঠে তার পিছু পিছু যেতে থাকলাম। সে আমাকে বিমানের লেজের কাছে এক্কেবারে পিছনের সিটে বসিয়ে দিয়ে চলে গেল। বলল এটাই নাকি আমার সীট!জীবনে খুব কম সময় পিছনের সিটে বসেছি। মনে পড়ে ছোট বেলায় একবার পিকনিকে যাবার সময় কপালে বাসের এক্কেবারে পেছনের সীটে স্থান হওয়ায় রীতিমতো কেঁদে দিয়েছিলাম। পরে বড় ভাইদের মধ্যস্থতায় সামনের দিকে বসার সৌভাগ্য হয়। সেইরকম মন খারাপ হতে লাগল। জীবনের প্রথম বিমান ভ্রমন তাও আবার পেছনের সীটে। আশেপাশের যাত্রীদের চেহারা দেখে মন আরও খারাপ হয়ে গেল। মহাখালী থেকে বগুড়ার বাসে উঠেছি যেন। চারিদিকে মফিজ আর মফিজ। অথচ এই আমি কি ভেবেছিলাম। যাই হোক; সে অনেকদিন আগের কথা। এরই মধ্যে আমি নিজেই মফিজ সেজে বেশ কয়েক ট্রিপ মেরে দিয়েছি - মফিজ ক্লাশের যাত্রী হিসেবে। অর্থ্যাৎ ইকোনোমি ক্লাশে। তবুও ভাল যে অফিসের দয়ায় বারকয়েক উড়তে পেরেছি। নিজের টাকার বিমান বন্দর পর্যন্ত যেতে সাহস হয় না আমার। যা বলছিলাম; আজকে আমার এই সহযাত্রী সাদা চামড়ার হিসাব নিকাশ করার ব্যাপারটা সত্যিও হতে পারে। খামোখাই ওকে দোষ দিয়ে লাভ কি। আমারই মনে হয় ’চোরের মন পুলিশ পুলিশ ভাব’। ওকে মাথা থেকে আপাততঃ ঝেড়ে ফেলে সীটের হ্যান্ডেল থেকে (রিমোট??) কন্ট্রোলটা বের করলাম। নিজেকে বড় কিছু প্রমান করার চেষ্টা না করলেও বড় বিটল প্রমান করতে ইংরেজী মুভির ’ভাল সিন’ গুলো টেনে টেনে দেখতে লাগলাম। ...........’হাই’ - দেখি ব্যাটা কাজকর্ম শেষ করে আমার দিকে মুচকি হাসি দিয়ে অপেক্ষা করছে। ’হ্যালো’, ’শালা ভাউড়া’ - আমিও বিগলিত হাসি উপহার দিলাম। পরের শব্দদুটো অবশ্য মনে মনে বললাম। ’হয়ার আর ইউ ফ্রম?’’আই এ্যাম ফ্রম বাংলাদেশ’ - বলেই অস্বস্তিতে পড়লাম। ব্যাটায় কি আমি কোন দেশের লোক তা বুঝাইল নাকি কোথা থেকে আইলাম তা বুঝাইল? আই সি, হোয়াট ডু ইউ ডু?’আই এম এ ফুড সিকিউরিটি ম্যানেজার।’ - বসের পদবী অবলিলায় নিজের বলে চালিয়ে দিলাম। ভাউড়ামি কি আমি জানিনা! হাতের যন্ত্রটা আবার যথাস্থানে ফেরত পাঠিয়ে একটা 'চাপা'যুদ্ধের জন্য মনে মনে প্রস্তুতি নিলাম। ’ফুড সিকিউরিটি?’ - তার ভ্র'কুটি দেখেই বুঝলাম ভুল যায়গায় ভুল শব্দ ব্যবহার করে ফেলেছি। ফুড সিকিউরিটির ব্যাপারটা ডেভলাপমেন্ট ফিল্ডের লোক যারা তৃতীয় বিশ্বের দরিদ্র অঞ্চল গুলোতে কাজ করে তারা ছাড়া আর কেউ সহজে বোঝার কথা না। জাপানী ট্রেইনারের কথা মনে পড়ল। ট্রেনিং ক্লাশে সে একটা জোক বলেছিল। সব ট্রেইনাররাই অবশ্য এরকম কিছু জোক স্টকে রাখে। ট্রেনিং ক্লাশে নিজের বলে চালিয়ে দেয়। আমার স্টকেও এরকম কিছু রাখি। যখন ট্রেনিং ফ্রেনিং করাই তখন আমিও এ রকম রেডি স্টকের কিছু কৌতুক নিজের বলে চালিয়ে দেই। এটা অবশ্য অন্যায় কিছু না। পার্টিসিপেন্টদের একটু আনন্দ দেয়া আর ট্রেনিং ক্লাশের একঘেয়েমি দুর করতে এটা সাহায্য করে। যাই হোক, কে একজন জাপানী ট্রেইনারের পরিচয় জানতে চাইলে সে বলেছিল যে সে ফুড সিকিউরিটি নিয়ে কাজ করে। ফলে লোকটি তাকে রেফ্রিজারেটর ব্যাবসায়ী মনে করেছিল।এই ব্যাটা অবশ্য তাৎক্ষনিক ভাবে ফুড সিকিউরিটিকে রেফ্রিজারেটর এর ব্যবসা মনে করলনা। 'হোয়াট কাইন্ড অব ফুড সিকিউরিটি?' - আমার নিরবতায় সে আবার প্রশ্ন করল। আমি যথাসম্ভব বোঝানোর চেষ্টা করলামঃ দরিদ্র দেশের মানুষ যাতে সারা বছরে কোন সময় খাবারের অভাবে না পড়ে; সময়মত যাতে খাদ্য পাওয়া যায় এবং সেই সাথে মানুষগুলো প্রয়োজনের সময় খাদ্য কিনে খাবার ক্ষমতা থাকে সে বিষয়টাই হচ্ছে ফুড সিকিউরিটি। ভাউড়া মনে হয় কিছুক্ষন চিন্তা করল। তারপর হঠাৎ - ’আই গট ইউর বিজনেস’ - বলে বিজ্ঞের মত মাথা উপর নীচ করতে লাগল। আমি ঠোট উল্টে চোখ বড় বড় করে তাকালাম তার দিকে যেন তার এই অবারিত জ্ঞানে আমি যারপরনাই স্তম্ভিতঃ।”ইউ আর ইন কোল্ড স্টোরেজ বিজনেস, রাইট?” ’ইয়েস ইয়েস ইউ আর কারেক্ট।’ - আমি অতি বিষ্ময়ে বিষ্মিত এরকম ভাব করে ভয়াবহভাবে তেপ্প্ন্নাবার মাথা উপরে নীচে ঝাকালাম। তারপর আবার রিমোট কন্ট্রোলটি টেনে বের করলাম।এই মাথা মোটার সাথে ফুড সিকিউরিটি নিয়ে আলাপ করার চেয়ে ক্রিস ওয়ার্ল্ডেও মুভি গুলোর ’ভালসিনগুলো’ রিওয়াইন্ড ফরওয়ার্ড করে মুখস্ত করা ঢের ভাল।

Tuesday, September 2, 2008

রহস্যময়ী (রহস্যগল্প)

এক.

’ঘরোয়া’; নাম এর সাথে পরিবেশ মানানসই। অল্প কয়েকটা টেবিল, ছিমছাম; খদ্দেরও কম। আশেপাশের হোটেলগুলোর তুলনায় দামটা একটু বেশী এখানে। এজন্যই হয়তো। তবুও এহোটেলটাই রাহাত পছন্দ করে। রাহাতের মতে এ হোটেল খুবই ‘কোয়ালিটি’ খাবার তৈরী করে।

আজ আবার একেবারেই খদ্দের নেই। একটু আগে অল্প বৃষ্টি হয়েছে বলেই হয়তো। আশেপাশের দু একটা টেবিলে দু’একজনকে দেখা যাচ্ছে। চিকেন বিরিয়ানীর অর্ডার দিয়েছিল রাহাত; যদিও খাবারটা ওর অতটা পছন্দ না। তাড়াতাড়ী খেয়ে অফিসে যেতে হবে বিধায় এই অর্ডার। ’শালার একটু আয়েশ নিয়ে খাব তার সময় নেই’ - আপনমনেই গজগজ করতে থাকে রাহাত। মাথার উপর আবার কিসের ঠুসঠাস শব্দ হচ্ছে। ধেৎ হঠাৎ রেগে যায় সে - এই হোটেলে আর আসবইনা - মনে মনে খিস্তি করতে থাকে সে।

সবে আর এক লোকমা পেটে চালান করেছে। হঠাৎ ধুম, ধাস্ ধরাস - জোরে বিকট শব্দ; তারপর আবার ভারী কিছু পতনের শব্দ। ভুমিকম্প, ভুমিকম্প -; মুহুর্তের মধ্যে লোকজন চিৎকার চেঁচামেচি শুরু করে দিল; কয়েকজন তাড়াহুড়ায় চেয়ার উল্টিয়ে ফেলল। রাহাত আবার এসব ক্ষেত্রে টিউবলাইট - চেয়ার থেকে সবে উঠে দাড়াল। সামনে অদ্ভুত কান্ড হয়ে গেছে। তাড়াহুড়া করে বের হতে গিয়ে ম্যানেজার ক্যাশ বাক্স উল্টিয়ে ফেলে চিৎ হয়ে পড়ে আছে। তার চারপাশে টাকা পয়সা ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। শোয়া অবস্থাতেই সে অভয় দিল ’ভাইয়েরা ডরাইয়েননা। উপরে কাজকর্ম চলতাছে তো তাই একটু শব্দ হইছে।’

ব্যাটা বেকুব। মনে ভাবে রাহাত। নিজেই আগে দৌড় দিতে গিয়া উল্টাইছে আর এখন বলে ডরাইয়েননা। চেয়ার থেকে একটু সামনে এগিয়েছিল সে. উল্টা ঘুরে নিজেই বেকুব হয়ে গেল। তার সামনের চেয়ারে শাড়ি পরা একটি মেয়ে বসে খাচ্ছে।

রাহাত নিশ্চিত তার টেবিলে আর কেউ ছিলনা। তবে কি অন্য টেবিলের কেউ; হযতো ছিল, ঢোকার সময় অতটা খেয়াল করেনি। অন্য টেবিলের মেয়েই হয়তো; কিন্তু এত তাড়াতাড়ি খাবারের প্লেট নিয়ে খেতে বসে গেল? ভয়ংকর একটা কান্ড ঘটে যাবার পরেও?

’রাহাত বসেন। অবাক হবার কিছু নেই। ওকে আরো অবাক করে দিয়ে মেয়েটি বলে উঠল।’ - আরে আশ্চর্য, মেয়েটি ওকে চেনে দেখছি এবং আরও আশ্চর্যের বিষয় যে মেয়েটাকে তার খুবই চেনা চেনা লাগছে। চোখের ইশারায় রাহাতকে বসতে বলল। ’আমাকে কি খুব চেনা চেনা লাগছে? আবারো অবাক করে জিজ্ঞেস করে বসে মেয়েটি।

দুর্দান্ত মেয়ে। এ মুহুর্তে আর কিছু ভাবতে পারছেনা রাহাত। কিন্তু এত চেনা চেনা লাগার কারন কি। ঘটনার আকষ্মিকতায় আসলে মাথা কাজ করছিল না। এতক্ষনে বুঝতে পারল কেন চেনা চেনা লাগছে। ’আপনি কি সুমনের, আই মিন, সুমন সাহেবের বোন নাকি?’

’যাক, অবশেষে বুঝতে পেরেছেন কেন চেনা চেনা লাগছে তাইনা। আপনার সাথে’বেশ কিছু কথা বলবতো তাই এটা করার দরকার ছিল। তারপর বলুন রেশমা, দীপ্তি ওরা কেমন আছে?’

মাথা এখন ঠিক মত কাজ করছে রাহাতের। আপনার স্ত্রী কন্যা কেমন আছে জিজ্ঞেস না করে নাম ধরে জানতে চাচ্ছে। অর্থ্যাৎ বোঝাতে চাচ্ছে যে সে তার বউ পোলাপানের নামও জানে।

হু, ঘাঘু মাল; সালার সময় কম নইলে। এ রকম মাল কি কওে টাইট দিতে হয় দাঁত কিড়মিড় করতে থাকে রাহাত। ’দ্যাখেন অনেক্ষন কথা বলার টাইম নাই। যা বলার একটু তাড়াতাড়ি বলেন।’

’আচ্ছা ঠিক আছে। তাড়াতাড়িই বলব। কিন্তু আমাকে টাইট দেবার ভাবনা কিন্তু আপনাকে ছাড়তে হবে। একরাশ রহস্যময় হাসি হেসে বলে উঠে মেয়েটি।’

’এরে খাইছে। এয় দেখি মনের কথা পইড়া ফালাইতেছে। হু, বোঝা যায় খুব শার্প মেয়ে।’ ঘড়ির দিকে চোখ পড়তেই আৎকে উঠে রাহাত। ধেৎ, একে নিয়ে এত ভাবাভাবির সময় নাই। রাহাত দ্রুত খেতে শুরু করে। সময় পার হয়ে যাচ্ছে। সোয়া একটার দিকে বের হয়েছে সে। দুটোর মধ্যে ফেরৎ যেতে হবে। ছোট্ট কিন্তু গুরুত্বপুর্ন একটা মিটিং এ্যাটেন্ড করতে হবে।

’আপনার মিটিং কয়টায়? দুটোয় না?’

এইবার একটু অবাক হয় রাহাত। এই মিটিং সম্পর্কে অল্প কয়েকজন শুধুমাত্র জানে। এমনকি সুমনও জানার কথা নয়। তাহলে? আর সুমন কেন তার বোনকে এগুলো বলবে আর তার বোনই বা কেন এরকম রহস্যময় আচরন করবে?

খাওয়া বন্ধ করে রাহাত। খুব শক্ত চোখে তাকায় সে মেয়েটির দিকে। ’পরিস্কার করে বলুনতো আপনার মতলব কি? আপনার এবং সুমনের উদ্দেশ্য কি?’

’যাক। একটু আগ্রহী যখন হয়েছেন তবে বলি। আমার নাম উম্ম্ এক মুহুর্ত থেমে বলে মেয়েটি ’মায়া।’ আর সত্যি কথা হল আপনার কলিগ সুমনের কোন ভুমিকা নেই এর মধ্যে। আর আমিও সুমনের বোন নই।’

যাহ শালা এইনা হলে পেজগী। এতক্ষনে এই কথা। তারপর আবার নিজের নাম কেউ ভেবে বের করে। হঠাৎ রেগে যায় রাহাত। ’তাহলে বলুন তো আপনে কোন সোনার চান্দ - কি কারনে আমার টাইম নস্ট করতেছেন?’

’আপনি রেগে যাবেননা।’ হাত উঠিয়ে থামায় মেয়েটি। ’আচছা আপনি খেতে থাকুন আর আমি বলতে থাকি। কেমন হয়? আপনারও খাওয়া হল আমারও বলা হল।’

’ভনিতা বাদ দেন। যা বলতে চান বলেন।’ - রাহাত দ্রুত খাওয়া শেষ করতে থাকে। অন্য দিন হলে কোনটা ঘুঘু আর কোনটা ফাঁদ দেখিয়ে দিতো। আজ না।

’আচ্ছা আপনি ভার্চুয়াল আইস স্কেটিং করেছেন? বা ভার্চুয়াল পাইলটিং যেখানে আপনার সত্যি সত্যি মনে হয় আপনি আইস স্কেটিং করছেন বা আকাশে বিমান চালাচ্ছেন।’ - মেয়েটি বলতে থাকে।

’কিসের মধ্যে কি; পান্তাভাতে ঘি। প্রসঙ্গ কোত্থেকে কোথায় যায়।’ - কিছু একটা বলতে গিয়েও থেমে যায় রাহাত। যা মন চায় বলুক। যাবার সময় ভজিয়ে ভাজিয়ে ফোন নম্বরটা রাখতে হবে। তারপর সুযোগ বুঝে একদিন ’কত কথা আছে পেটে’ দেখতে হবে। হু, হ্যা করতে করতে খেতে থাকে রাহাত।
আমি জানি আপনি করেননি। তবুও হু, হ্যা করছেন। যাই হোক। এগুলো একধরনের খেলা। যারা আইস স্কেটিং করতে ভয় পান তাদের কাছে এটি একটি মজার খেলা। আপনার চোখে বড়সড় একটি সানগ্লাস টাইপের বস্তু বসিয়ে দেয়া হয়; যেটা আদতে দুটো স্ক্রিন; চোখের সামনে থাকে। স্ক্রিনে আপনি চারিদিকে বরফ দেখতে থাকেন - যেদিকে তাকান সেদিকেই দেখা যায় –

’থামেন’- হাত তুলে থামিয়ে দেয় রাহাত মেয়েটিকে। ’অত লেকচার দিতে হবে না আপনার। কি বোঝাতে চাইছেন তার চেয়ে বেশী বুঝে নিয়েছি। দ্য মেট্রিক্স মুভিটির তিনটি পার্টই আমি দেখেছি বহুবার। অতএব, বটম লাইন বলেন।’

’একইভাবে একটি নির্দিস্ট যায়গায় বসে আকাশে ভার্চৃয়াল বিমানও চালায় মানুষ। ব্যাপারটা আসল বলেই মনে হয় তাইনা।?’

’কনক্লুসন বলেন।’ - বাম হাত ট্রাাফিক পুলিশের মত উঠিয়ে আবারো মেয়েটিকে থামায় রাহাত।

’হ্যা, ঠিক আছে, কনক্লুসন করি। তবে যা বলছিলাম। ঐ যে ভার্চূয়াল আইস স্কেটিং আর ভার্র্চুয়াল বিমানে প্লে করানোর জন্য যেমন একজন কন্ট্রোলার দরকার হয় তেমনি প্রতিটি মানুষকে পরিচালনা করার জন্যও একজন কন্ট্রোলার দরকার হয়। যদিও দুটো কন্ট্রোলারের মধ্যে কাজেরও বিস্তর ফারাক।’

তো - ? রাহাতের খাওয়া প্রায় শেষ। মাথা উঠিয়ে মেয়েটির চোখে তাকায় সে।

’আমি হচ্ছি আপনার কন্ট্রোলার।’ - রাহাতের চোখে চোখ রেখে শান্ত স্বরে বলে ওঠে মেয়েটি।

‘মানে?’ - রাহাত এবার কনফিউজড। পাগল টাগল নয়তো? চুপচাপ পালিয়ে এসেছে হাসপাতাল থেকে। ধুর পাগল হলে তো আর নাম ধাম বলতে পারতো না। কাহিনী কি? বেকুব বানয়া দিল তো।

এদিকে সময় শেষ হয়ে যাচ্ছে। দুটো কি বেজে গেল? ঘড়ির দিকে তাকিয়ে আবারো বোকা বনে যায় রাহাত। ঠিক দেড়টা বাজে। কি মুশকিল ঘড়িটা কি নস্ট হয়ে গেল? মিনিমাম একঘন্টা পার হয়ে গেছে। দেয়ালের দিকে তাকাতেই দেখল হোটেলের ঘড়িতেও ঠিক দেড়টাই বাজে!

’দেখুন ঘড়ি নষ্ট হয়নি। সময় ঠিকই আছে। আপনি দুঃচিন্তা করবেন না। দুটোর মিটিংএ আপনি ঠিকই পৌছতে পারবেন। ’ - মেয়েটি বলে উঠে।

উহ্, মাথা আবার আউলা হয়ে যাচ্ছে। ক্রুদ্ধ রাহাত জিজ্ঞেস করে মেয়েটিকে - ”আচ্ছা বলুনতো কি হচ্ছে এসব। আমি শিওর আপনি সব জানেন। আপনি কি চান।”

দেখুন কন্ট্রোলার হিসেবে আমার দায়িত্ব হল আপনি ঠিকঠাক চলছেন কিনা তা মনিটরিং করা। আমি আপনার ব্যাপারে একটা বিষয় আমার বসকে রিপোর্ট করেছি। সে প্রেক্ষিতে আপনার ব্যাপারে আমরা একটা বিশেষ সিদ্ধান্তও নিয়েছি। আপনার জীবন চলার পেছনে যে ফিল্মটা দায়ী তা আমরা পাল্টে নতুন একটা লাগিয়ে দেব।

’ধেৎ পাগলের প্রলাপ’ - টেবিলে কিল বসিয়ে উঠে দাড়ায় রাহাত। কিন্তু মেয়েটির দিকে তাকিয়ে অবাক হয়ে যায়। কি এক সম্মোহনী দৃষ্টি দিয়ে তাকিয়ে আছে মেয়েটি! ধীরে ধীরে আবার চেয়ারে বসে পড়ে সে। মেয়েটি তার ডান হাত রাহাতের কপালে ছোয়ায়। রাহাতের চোখের সামনে ভেসে আসে অদ্ভুত দৃশ্য। তার প্রথম সন্তানের মুখ। যে চলে গেছে অনেকদিন আগে।

পুরোনো অনেককিছুই তার চোখের সামনে ভেসে উঠতে থাকে। সিনেমার ট্রেইলরের মত। তার সন্তানের জন্ম - তারপর অসুস্থতা। পাগলের মত হাসপাতালে ছুটোছুটি। তিন বছরের ব্যার্থ চেষ্টা। তারপর চিরনিদ্রায় শয়ন।


দুই.

বাইরে ঝুম বৃস্টি হচ্ছে। চেয়ারে স্তব্ধ হয়ে বসে আছে রাহাত। যা দেখল বা জানল তার কিছুই অবিশ্বাস করতে পারছে না সে। পুরোনো অনেক স্মৃতিই একেবারে জীবন্তভাবে আবার দেখল সে - কোন স্বপ্ন নয়। এতক্ষনে বিশ্বাস করল ঐ মেয়ে তার জগতের কোন মেয়ে নয়। আর সময় বলে কিছু নেই! সময়কে ইচ্ছেমত থামিয়ে দেয়া যায়! এগিয়ে পিছিয়ে নেয়া যায়!

এক যুক্তিতেই তাকে ধরাশায়ী করেছে মেয়েটি। -’তুমি যখন স্বপ্ন দেখ তখনকার জগতে যেমন তুমি ছাড়া আর কারো কোন অস্তিত্ব থাকে না ঠিক তেমনিভাবে তোমার এ জগতটাও বড় এক স্বপ্নের অংশবিশেষ; যেখানে আর কারো অস্তিত্ব নেই। আর সে স্বপ্নের কারিগর আমরা।’

এতক্ষনে সে বুঝতে পেরেছে যে সে নিজেই একজন গিনিপিগ। এতদিনের দেখে আসা তার ভুবনে আসলেই সে নিজে ছাড়া আর কারোরই অস্তিত্ব নেই। ভার্চুয়াল আইস স্কেটিং এর মত; ভার্চুয়াল বিমান চালানোর মত। এক জায়গায় স্থির অবস্থায় রয়েছে সে। যেখানে তাকে কন্ট্রোল করছে এই মেয়েটি - তার বা তাদের রিসার্চের অংশ হিসেবে। যেখানে এই জগত সংসার সবই তার সাথে সংযুক্ত মাইক্রোফিল্ম এর কারসাজি। তার জগত সংসার স্ত্রী কন্যা সব কিছুই ভার্চুয়াল! সে আরো উন্নত মানুষ তৈরীর গবেষনায় গিনিপিগ হিসেবে ব্যাবহৃত হচ্ছে। আরো উন্নত মানুষ!!!

না বিশ্বাস করেও উপায় নেই। তার প্রকৃত অবস্থান সে নিজেই প্রত্যক্ষ করেছে। মেয়েটিই দেখিয়েছে। বিশাল গবেষনাগার যার কেন্দ্রে অনেকগুলো চেম্বারের মত; প্রতিটি চেম্বারে মনুষ্যাকৃতির মুর্তি আধশোয়া অবস্থায় পড়ে আছে। ওগুলোর মধ্যে একটা নাকি সে নিজে - রাহাত। মেয়েটির ভাষ্যমতে অন্যান্য মুর্তিগুলোরও জন্যও রয়েছে একজন করে কন্ট্রোলার। তবে বেশ কিছু প্রশ্ন করে তার উত্তর পায়নি রাহাত। কন্ট্রোলার হিসেবে মেয়েটির জ্ঞানও নাকি সীমাবদ্ধ; একটা নির্দিস্ট পর্যায় পর্যন্ত। ওদের রিসার্চারেরাই জানে সবকিছূ। কিভাবে মানুষকে একটা নিজস্ব ক্ষমতা দিয়ে দেওয়া হয়। ভবিষ্যতে কি হবে। ইত্যাদি ইত্যাদি।

অনেক্ষন পর কিছুটা ধাতস্থ হয়ে রাহাত প্রশ্নকরে - ’তাহলে এখন কি হবে?’

রাহাতের কথা ধরেই যেন বলে উঠে মেয়েটি - তোমার নতুন ফিল্ম জুড়ে দেবার পর থেকে তুমি একটা নির্দিস্ট সময়ের পরের সব কিছু ভুলে যাবে। পুরোনো স্মৃতিই থাকবে তোমার মধ্যে। কিন্তু তুমি আবার শুরু করবে অতীত থেকে। আমরা দেখেছি তোমার সন্তানের প্রতি তোমার ভালবাসা। তোমাকে যেটুকু নিজস্ব ক্ষমতা দেয়া হয় তার পুরোটাই তুমি ব্যায় করতে তোমার সন্তানের পেছনে - যেখানে আমাদের কোন ভুমিকা ছিল না। তুমি সত্যিই তোমার সন্তানকে ভীষন ভালবাসতে। তাই এবারের জীবনপর্বে তোমার এই দুঃখটা আর থাকবেনা; তোমার সন্তানকে তোমার কাছে ফিরিয়ে দেয়া হবে, সম্পুর্ন সুস্থ অবস্থায়।


তিন.

’স্যার, ও স্যার’ - হঠাৎ কানের পাশে কারো গলা শুনে সংবিত ফিরে পায় রাহাত। কয়েক মুহুর্ত স্থান কাল পাত্র কিছু মনে করতে পারে না। সামনের মুখটা কেমন অপরিচিত মনে হয়।

’আমি কোথায়?’ - নিজের মনে নিজেকেই প্রশ্ন প্রশ্ন করে রাহাত।

’স্যার, আপনে তো চেয়ারে হেলান দিয়া ঘুমায়া গেছেন। আপনেরে খুব কেলান্ত লাগতাছে। এই যে আপনের খানা। ’ - হোটেল বয় টেবিলে খাবার সাজিয়ে দেয়।
হঠাৎই সব মনে পড়ে যায় তার। ছিঃ ছিঃ হোটেলে খাবারের অর্ডারদিয়ে চেয়ারে হেলান দিয়ে ঘুমিয়ে পড়েছে সে। ধেৎ। আসলে অফিসে এত বেশী কাজ করতে হয়েছে আজ যে - হাত ঘড়ির দিকে তাকিয়ে আৎকে ওঠে সে। তাড়াতাড়ি প্লেটটা টেনে নিয়ে খেতে আরম্ভ করে।

সবে দু এক লোকমা পেটে চালান করেছে। হঠাৎ ধুম, ধাস্ ধরাস - জোরে বিকট শব্দ করে তারপর আবার ভারী কিছু পতনের শব্দ। ভুমিকম্প, ভুমিকম্প - লোকজন চিৎকার চেচামেচি শুরু করে দিল;কয়েকজন তাড়াহুড়ায় চেয়ার উল্টিয়ে ফেলল। টিউবলাইট রাহাত চেয়ার থেকে উঠে দাড়াল। সামনে অদ্ভুত কান্ড হয়ে গেছে। ম্যানেজার ক্যাশ বাক্স উল্টিয়ে ফেলে চিৎ হয়ে পড়ে আছে। তার চারপাশে টাকা পয়সা ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে;। শোয়া অবস্থাতেই সে অভয় দিল ’ভাইয়েরা ডরাইয়েননা। উপরে কাজকর্ম চলতাছে তো তাই একটু শব্দ হইছে।’

ব্যাটা বেকুব। মনে মনে ভাবে রাহাত। নিজেই আগে দৌড় দিতে গিয়া উল্টাইছে আর এখন বলে ডরাইয়েননা। ফিরে এসে আবার খেতে বসে। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে আবার আঁৎকে উঠে। দুটো বাজতে ২০ মিনিট বাকী। তাড়াতাড়ি খেতে থাকে সে। দুটোয় একটা জরুরী মিটিং আছে। তারপর এক সপ্তাহের ছুটি। কারন পরশু তার বিয়ে। রেশমার মুখটা মনে পড়ে বিচিত্র ভাললাগায় মনটা ভরে যায় তার। দ্রুত প্লেটে হাত চালায় সে।

ভুতের বাড়ি

বাসাটা দেখেই পছন্দ হয়ে গেল শম্পার। কি সুন্দর! ঢাকা শহরে দুইদিকে খোলামেলা বাড়ি খুজে পাওয়া মুশকিল। বিশেষ করে মগবাজারের মত এলাকায়। হাসান সেই অসাধ্য সাধনই করেছে। বেশ বড়সড় বাসাটা। পুর্ব ও উত্তর পাশে দুদিকেই খোলা। দুটো বেডরুম; ড্রইং - ডাইনিং। মাস্টার বেডরুমের সাথে বড় বারান্দা। যদিও দুই বেডরুমের বাসার কোন প্রয়োজন ছিলনা - তারা দুজন মাত্র মানুষ। তবুও হাসানের সবসময়ই একটু বড় বাসা পছন্দ - 'আত্মীয় স্বজন কেউ এলে যাতে শোয়ার আলাদা ব্যবস্থা থাকে সেজন্যই দুটো বেড দরকার' - এই হচ্ছে হাসানের বক্তব্য।

বাসাটা অবশ্য একটু পুরোনো ধাঁচের। দশ বার বছরের পুরোনো তো হবেই। আর ভেতরটা এখনকার বাড়িগুলোর মত এত আধুনিক নয়। অবশ্য সে কারনে ভাড়াটাও তুলনামুলকভাবে একটু কম হয়েছে।

তার কাছে সবচেযে ভাল লাগে রাতের ঢাকা। প্রথম রাতে বারান্দায় গিয়ে বিষ্ময়ে হতবাক হয়ে গিয়েছিল সে। কি সুন্দর লাগছে দেখতে আশেপাশের দৃশ্য। দশতলার উপরথেকে এলাকার বড় একটা অংশ চোখে পড়ে। রাস্তাঘাট, অফিস, বাড়ি, মার্কেট সব! রাতে বারান্দা থেকে সবকিছু ঝলমলে আলোকিত দেখায় - বিশেষ করে আলোকিত জানালাগুলো দেখতে তার কাছে অদ্ভুত সুন্দর লাগে। বিয়ের পর মালয়েশিয়ায় বেড়াতে গিয়েছিল তারা। রাতের বেলা হোটেলের ব্যলকনি থেকে অদ্ভুত লেগেছিল তার কাছে কুয়ালালামপুর সিটি; তার মনে হয়েছিল আর জীবনে বুঝি আর ওরকম দৃশ্য দেখা হবে না। অথচ নিজের ঘর থেকেই এখন ওরকম দৃশ্য চোখে পড়ছে!

এখানকার প্রতিবেশীরাও বেশ মিশুক। ইতিমধ্যে পাশের বাসার মহিলার সাথে তার বেশ সখ্যতা গড়ে উঠেছে। বয়সে শম্পার থেকে খুব একটা বড় হবে না অথচ এরই মধ্যে দুই বাচ্চার মা। মহিলা তুলনামুলকভাবে অনেক ভাল। অন্ততঃ আগের বাসার প্রতিবেশী থেকে।

আগের বাসায় প্রথমদিন উঠে জিনিসপত্র গুছিয়ে সৌজন্য দেখাতে পাশের বাসায় নক করল সে। খান্ডারনী চেহারার এক মহিলাকে দেখা গেল দরজায়; শাড়ীর আচল পেচিয়ে কোমড়ে গোঁজা। শম্পার মনে হল মহিলা এই মাত্র তার স্বামীকে একচোট কিলিয়ে তারপর হাত ধুয়ে এল।

’কি চাই?’ - শাড়ীর আচল দিয়ে হাত মুছতে মুছতে জিজ্ঞেস করে খান্ডারনী।

'জি মানে আমরা নতুন এসেছি। এই পাশের ফ্লাটে।' - আঙ্গুলের ইশারায় তার বাসার গেটের দিকে ইঙ্গিত করল শম্পা। মহিলাকে আন্টি বলবে নাকি আপা সেটা বুঝে উঠতে পারছে না।

’তাই নাকি’? - যেন ব্যাঙ্গ করে উঠল মহিলা।

শম্পা একটু মুচকি হাসার চেষ্টা করল। মহিলার মুখে কোন ভাবান্তর নেই। আজব মানুষ। আরে দুদন্ড কথাবার্তা বল। কথাবার্তা কি বাজার থেকে দাম দিয়ে কিনে আনতে হয়। বললেই ফুরিয়ে যাবে।

’আচ্ছা ঠিক আছে, আজ যাই আরেকদিন আসব। আপনাকে খুব ব্যাস্ত মনে হচ্ছে’ - শেষে না পেরে নিজেই আবার বলে উঠে।

'আচ্ছা ঠিক আছে।' - বলেই দরজা লাগাতে শুরু করল মহিলা! যেন এই সুযোগের অপেক্ষাতেই ছিল সে!

প্রচন্ড রকম মেজাজ খারাপ হয়ে গেল শম্পার; অস্ফুটকন্ঠে বলেই ফেলল - ’যান এবার নতুন উদ্দমে কিল শুরু করুন।’

ওবব্বাহঃ সাথে সাথেই আবার দরজা খুলে গেল। ’কিছু বলছিলেন?’ শুনে ফেলল নাকি!

'না মানে বলছিলাম আপনিও আসবেন কিন্তু।'- ভেঙচি হাসি হাসল শম্পা।

'আচ্ছা।' - দড়াম করে বন্ধ হয়ে গেল দরজা।

সেই আগের অভিজ্ঞতার কথা মনে রেখে বেশ ভয়ে ভয়ে পাশের বাসার দরজায় নক করে সে। শুরুতেই মহিলার মিষ্টি হাসিমুখ দেখে মনে মনে আপন করে নেয় তাকে। বেশ মিশুক এই প্রতিবেশী। তবে একটু ফাজিল টাইপের। প্রথম দিনেই তা টের পাওয়া গিয়েছে।

'আপনাদের নতুন বিয়ে বুঝি।' - মুখ টিপে হেসে জিজ্ঞেস করে; চোখে দুষ্টুমির আভাস।

'হ্যা, কেন?' - একটু ভারীগলায় উত্তর হয়ে গেল তার! নতুন বিয়ে হয়েছে বলে মুখ টিপে হাসতে হয় নাকি?

'ও মা, এ দেখি লজ্জা পায়! তা দুজনে রাতে দু বিছানায় ঘুমান নাকি?'

'না তা কেন হবে।'

'-ও আচ্ছা, এক বিছানাতেই থাকেন। তা রাতে ঘুমানতো ঠিকমত? নাকি সারারাত ডলাডলি করে কাটান?'

'কি বলছেন এসব। আমার শুনতে ভাল লাগছে না।'

'ভাল না লাগারই কথা। আগে আমারও ভাল লাগত না। আমার মত দুটো বাচ্চার মা হোন দেখবেন এসব শুনতে আপনারও ভাল লাগছে। '

'তাই নাকি? আপনার দুটো বাচ্চা?'

'ক্যান বিশ্বাস হয়না?'

'না ঠিক তা নয়। আপনাকে সেরকম লাগে না।'

'কি করবো ভাই, এগুলো সবই ওভারটাইমের ফল। জামাই আমার কর্মক্ষেত্রের চেয়ে ঘরে ওভার টাইম করতে বেশী পছন্দ করে।' - চোখ টিপে উত্তর দেয় মহিলা!

দুই.

খুব সহজেই কাজের একটা বুয়া পাওয়া গেল। ঐ মহিলাই কাজের বুয়াটা জোগাড় করে দিলেন। অবশ্য জোগাড় ঠিক না। তাদের বাসায় কাজ করে। ওদের বাসায়ও করবে। অন্য কেউ হলে নিজের বাসার কাজের ক্ষতি হবে ভেবে এ খবরই দিত না। এ কারনে মহিলাকে আরো বেশী ভাল লেগে যায় শম্পার।

’জমিলার মা কাজকর্মে খুবই ভাল। কোন চুরিচামারীর স্বভাব নেই। তবে ও সবসময় আবোলতাবোল বকে; উল্টা পাল্টা কথা বলে। ওকে বেশী পাত্তা দিবেন না।’ - জমিলার মার সম্পর্কে জানিয়ে দেন তিনি।

সত্যিই খুব বকরবকর করে জমিলার মা। কথা ছাড়া কোন কাজই করতে পারেনা সে।

'আফনেরা দুইজন মাত্র মানুষ তা এত বড় বাসায় উঠছেন ক্যান?'

'এত বড় বাসা হল কোথায়। আর আমাদের আত্মীয়স্বজন আসলে তাদের থাকার যায়গা দিতে হবে না?'

'কি জানি। চাইরতালায়তো এই বাসায় বিশ জন মানুষ থাহে। এক ঘরে পাচজন কইরা। '

'তাই নাকি?'

'হ, বেডায় মনে লয় এলাকার লোকজনরে ডাইকা তার বাসাত উঠায়। হইটাল বানাইছে হইটাল। সব মিলায়া ২০ জন মানুষ। আমি তো দেইখা তাব্বা খাইয়া গেলাম হেইদিন। এত মানুষ এক ঘরে থাকে। বিল্ডিংডাও মনে লয় এত মাইষের ভার সহ্য করতে পারে না। হেইদিন দেখলাম বিল্ডিংডা কাইত হইয়া গেছে।'

'কাইত হইয়া গেছে মানে?'

'ক্যা বাসায় ঢুকতে দেখেননা? বিল্ডিংটা ডাইনদিকে কাইত?'

'তাই নাকি? খেয়াল করিনি তো!'

'এত মানুষ এক ঘরে থাকলে বিল্ডিং কাইত হইবনা? তয় ঠিকমত না চাইলে দেখা যায় না। '

'ও আচ্ছা।'

ফালতু কথার পাশাপাশি বাজে কথায়ও ওস্তাদ। সেদিন কথায় কথায় হাসানের সাথে কিভাবে পরিচয় তারপর বিয়ে এসব জিজ্ঞেস করছিল সে।

'আসলে ও খুব ভাল মানুষ' - হাসান সম্পর্কে মন্তব্য করতেই জমিলার মা শুরু করে -'ব্যাডা মাইনষেরে বিশ্বাস নাইগো আফা ব্যাডা মাইনসেরে বিশ্বাস নাই। হেরা হারাদিন উপরে উপরে মিষ্টি মিষ্টি কতা কইবো আর তলে তলে আকাম করবো।'

'মানে?'

'মানে আফনের মতন তিনতালার ব্যাডার বউও কইতো হের সোয়ামী নাকি ফেরেস্তার লাহান মানুষ। কিন্তুক হেই ব্যাডায়ও বউ বাড়িত গেলে ভাড়াইট্যা মাগী নিয়া ফুর্তি করে। '

'কি যা তা বলছ?'

'আমি কি মিছা কতা কই? হের বউ বাপের বাড়িত গেছিল। আমি সকালে কামে গেছি। দেহি ব্যাডার বাইত অন্য মাগী। ভাবছিলাম হের কোন আত্মীয় হইব। পরে হেই মাগীরে জিগাইলাম। অয় কয় হে নাকি হের ফেরেন্ড। '

'তুমি চুপ করতো? ভদ্রলোকের পরিচিত মেয়েরা বাসায় আসতে পারেনা।'

'হ, তা পারে, তয় অর বউ বাসায় থাকতে তো বেডিরে কুনদিন আইতে দেখি না।'

'তুমি চুপ কর। আর একটা কথাও বলবে না।'

তারপরও একা একা গজর গজর করতেই থাকে সে।

অবশ্য কাজের হাত খুবই ভাল জমিলার মা’র। শম্পাকে কিছু বলতে হয় না - নিজেই সব করে দেয়। এ কারনেই তার ফালতু অসভ্য কথাবার্তায় খুব একটা আমল দেয় না সে। অবশ্য শম্পা নিজেই মাঝে মধ্যে কথা শুরু করে তার সাথে। জমিলার মা ছাড়া আর কেই বা আছে কথা বলার মত! একা বাসায় কথা না বলে থাকতে পারে না সে - দম বন্ধ হয়ে আসে।

'আচ্ছা বুয়া - তুমি কি জান আমাদের এই বাসায় আগে কারা থাকত?'

'বাড়িওলার মাইয়া আর তার জামাই থাকতো। ক্যান আপনেরে কেউ কয়নাই?'

'না ঠিক তা নয়। আসলে জিজ্ঞেস করা হয়নি। '

'আর কইয়েন না। হেরা দুইডাই আছিল বদের গুরা। হারা দিন কাইজ্যা করত। কিলাকিলি চুলাচুলি কোনডাই বাদ যাইতনা। একদিন আমার সামনেই বেডি টান দিয়া ব্যাডার লুঙ্গী ছিড়া হালাইল। বেডায়ও কম যায়না - হেও টাইনা ম্যাস্কি ছিড়া ন্যাংটা কইরা ফালাইল অর বউরে। '

'তুমি চুপ কর। একটাও বাড়তি কথা বলবে না। আমি যা জিজ্ঞেস করব শুধু তার উ্ত্তর দেবে। ঠিক আছে?'

'আইচ্ছা হ, ঠিক আছে।'


তিন.

জি,এম,জি,র ফ্লাইট শিডিউল দেখছিল হাসান। নেক্সট রবিবার অফিস ছুটি। তিনদিনের ট্যুর করা যেতে পারে কক্সবাজারে। অনেকদিন থেকেই কক্সেসবাজারে যেতে চাইছে শম্পা। হাসানের জন্য যায়গাটা পুরোনো। সে কারনেই যাওয়ার প্রতি তার আগ্রহ হয়নি। এবার বউকে ছোট্ট একটা সারপ্রাইজ দেবার চিন্তাভাবনা করছে সে। সব রেডি করে শম্পাকে চমকে দেয়া। মনে মনে সারপ্রাইজ দেবার স্ক্রীপ্টও ঠিক করে ফেলে সে।

পরবর্তী বৃহঃবার একটু আগেভাগেই বাসায় পৌছে যাবে সে।

’শরীরটা ভাল লাগছে না তাই চলে এলাম। ’

'কি হয়েছে? শম্পা উদ্বিগ্ন হয়ে গায়ে হাত দিয়ে দেখবে - কই গায়ের তাপ তো ঠিকই আছে?'

'খারাপ লাগছে কেন?'

'শরীর কিছু চাচ্ছে মনে হয়। '

'দেখ দিনে দুপুরে ঝামেলা করবেনা বলে দিলাম। '

'আরে আমি চাইলাম কি আর তুমি ভাবছ কি? শরীর একটু ঘোরাফেরা করতে চাইছে আরকি।'

'ও, এই কথা তাহলে চলনা যাই। বড় আপার বাসা থেকে ঘুরে আসি। '

'না আশে পাশে কোথাও যাব না। ঢাকার বাইরে চলে যাব। '

'তাহলে চল কক্সেজবাজার যাই। আমার কত শখ কক্সেসবাজার সমুদ্র দেখার। '

'ঠিক আছে তাই সই; কাল সকালেই কক্সবাজার চলে যাব তুমি পোটলা গোছাও। '

শম্পা কিছুটা বিষ্মিত হবে। সে তখন টিকিট দুটো দেখিয়ে তার বিষ্ময় বাড়িয়ে দেবে।

'নাহ' - স্বগতিক করে হাসান। এই স্ক্রিপ্টটা পছন্দ হচ্ছে না তার। একটু ম্যাড়মেড়ে হয়ে যায়। রস কম। আরেকটা স্ক্রীপ্ট ভাবে সে।

বৃহঃবার বিকেলে এসেই হুঙ্কার ছাড়বে সে - 'চল, ছুটিটা আমাদের গ্রামে গিয়ে বাবা মার সাথে কাটিয়ে আসি।'

সে জানে শম্পার শ্বশুর বাড়ি যেতে আগ্রহ কম। তারপরও সে হাসানকে খুশি রাখতে যেতে রাজি হবে। পরদিন ভোরে তারা ট্যাক্সিকরে বাসস্টেশনের দিকে রওনা হবে।

শম্পা যেতে যেতে বলতে থাকবে - 'বাবা মার কাছে যেতে আনইজি লাগে। একটু পর পর নামাজ পড়, কোরান পড় ইত্যাদি ইত্যাদি বলতে থাকেন। আমার বিরক্ত লাগে।'

'ও, তোমার যেতে ইচ্চে করছে না?'

'না, ঠিক তা না। তবে অন্য কোথাও গেলে আরও ভাল লাগত।'

'আচ্চা ঠিক আছে তোমার পছন্দের যায়গায়ই যাব তাহলে। বল কোথায় যেতে চাও।
'তুমিতো জানই আমি কোথায় যেতে চাই।'

'ও হ্যা, তাইতো। এই ট্যাক্সি' - সে ট্যাক্সিওলাকে বলবে ’এয়ারপোর্ট চল।’

তারপর শম্পার দিকে তাকিয়ে বলবে ’কক্সেসবাজারই চলে যাই। তুমি কি বলো?’

শম্পা ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে থাকবে। ও নিশ্চয়ই আরো অবাক হয়ে যাবে যখন এয়ারপোর্টে গিয়ে তারা কক্সেসবাজারের ফ্লাইট ধরবে।

হঠাৎই সেল ফোনটা বেজে উঠল। বিরক্ত ভঙ্গিতে ফোনটার দিকে তাকাল। দিলতো সারপ্রাইজ নাটকের রিহার্সেল নষ্ট করে! ইদানীং ফোনগুলো বেশ বিরক্ত করছে। যার বেশীরভাগই ক্রস কানেকশন অথবা রং নাম্বার। এইতো কিছুক্ষন আগে একটা ফোন এল। ফোন ধরে হ্যালো বলার আগেই ওপাশ থেকে কেউ একজন বলতে শুরু করল -

”হ্যালো - টিএনটি অফিস। আমার একটা টেলিফোন ডেড হয়ে গেছে।”

মেজাজ খারাপ হয়ে গেল হাসানের - ”আহা তাই নাকি; চরম দুসংবাদ। কি আর করবেন; কাফন পেচিয়ে কবর দিয়ে ফেলেন।”

'কি? তামাশা করেন আমার সাথে? জানেন আমি কে?'

'হ্যা জানিতো, আপনি মরা টেলিফোনের বাপ; যাই হোক, কুলখানির আয়োজন করলে জানায়েন কিন্তু।'

ঘটাং করে রিসিভারটা রেখে দেয় সে। 'শালার যন্ত্রনা।'

তবে সেল ফোনেরস্ক্রীনে তাকাতেই বিরক্তভাবটা কেটে গেল তার। শম্পাই ফোন করেছে।

'হ্যাল্লো ডিয়ার হামিঙবার্ড।' - চেয়ারে আস্তে হেলান দিয়ে গলায় মধূ ঢেলে কথা শুরু করল হাসান।

হামিঙবার্ডের গলা খাচায় আটকানো লাভবার্ডের মত ভীতসন্ত্রস্ত আর করুন শোনাল - 'এই শুনছো। তুমি তাড়াতাড়ি বাসায় চলে এস। আমি আর এক মুহুর্ত এখানে থাকব না। আমার ভয় করছে। '

'তড়াক করে চেয়ারে সোজা হয়ে বসল হাসান -কেন কি হয়েছে?'

'এটা ভুতের বাড়ি। '

'ভুতের বাড়ি? কি বলছো?'

'হ্যা এইটা ভুতের বাড়ি। এই বাসা ভাল না। '

'তাই নাকি? তুমি কি ভুত দেখেছ নাকি?'

'তুমি কি জান বাড়িওলার মেয়ে এই বাসায় থাকত?' - উল্টো হাসানকে প্রশ্ন করতে শুরু করল শম্পা।

'হ্যা তাতে কি হয়েছে?'

'বাড়িওলার মেয়ে আত্মহত্যা করেছে এই ঘরে?'

এক মুহুর্ত থামল হাসান। ’তাতে কি হয়েছে?'

'কি হয়েছে মানে? তুমি ব্যপারটা জানতে?'

'হ্যা জানতাম। মানুষ আত্মহত্যা করেনা?'

'আশ্চর্য তুমি আমাকে বলনি কেন?'

'এটা বলার মত কোন ব্যপার হল?'

'ও এই জন্যই এটা বেশ ভাল বাসা, অনেক কমে পাওয়া গিয়েছে এগুলো বলে আমাকে ভুলিয়েছ?'

'না তা ঠিক না। আর যে মরেছে সে তো মরেই গেছে। তাকে ভয় পাওয়ার কি আছে?'

'এটা ভয় পাওয়ার ব্যাপার না?'

'আহা, দেখ পৃথিবী সৃষ্টির পর থেকে বাংলাদেশের বুকে কমসেকম কয়েক হাজার কোটি মানুষের মৃত্যু ঘটেছে। সে কারনে যারা বেচে আছে তাদের ভয় পেতে হবে?'

'তুমি বুঝছনা? মেয়েটা আমাদের বেডরুমের ফ্যানে ঝুলে মরেছে। আমি বেডরুমে ঢুকতে ভয় পাচ্ছি। তুমি তাড়াতাড়ি চলে আস। '

'ঠিক আছে। আমি আসছি। তবে তুমি খুব একটা ভয় পেয়োনা। বাড়িওলার মেয়ে ভুত হলে তোমাকে ভয় দেখানোর কথা না - আমাকে দেখালেও দেখাতে পারে। '

'দেখ ইয়ার্কী করো না - পাশের বাসার ভাবি নেই বাসায়। আমার একা থাকতে প্রচন্ড ভয় করছে। তুমি তাড়াতাড়ি এস।'

আর কথা বাড়ানো সমিচিন হবে না মনে করল হাসান ’ঠিক আছে, আমি আসছি। '

যন্ত্রনা হল তো!


চার.

হাসান বেশ তাড়াতাড়িই বাসায় চলে এল। সদর দরজা খোলা - শম্পা ড্রইংরুমে বসে ছিল। তাদের বেডরুমের দরজা বাইরে থেকে লাগানো।

'কি ব্যাপার; এত ভয় পাওয়ার কি ঘটল? আর এ ঘরের দরজা বন্ধ করে রেখেছ কেন?

হাসান ওঘরে ঢুকতে চাইলেই শম্পা বাধা দিতে শুরু করল। ''তুমি ও ঘরে যেও না। '

'কেন?''ঐ ঘরে আত্মহত্যা করেছে বাড়িওলার মেয়ে। '

'দেখ তুমি খামোখা ভয় পাচ্ছ। আর ভয়টা কমার বদলে ধীরে ধীরে বাড়ছে। '

দরজা খুলে ভেতরে ঢুকল হাসান। শম্পাকেও ডাকল ভেতরে। কিন্তু সে ঢুকল না।

বাধ্য হয়ে ড্রইংরুমে এসে বসল তারা। ''দেখ - বাংলাদেশে তো এ পর্যন্ত অনেক মানুষ আত্মহত্যা করেছ। তাদেও মধ্যে কতজন ভুত হয়ে ফিরে এসেছে? '

'দেখ তুমি আমাকে উল্টা পাল্টা বুঝিও না। তুমি আজই বাড়িওলাকে বলে দাও। আমরা এমাসেই বাসা ছেড়ে দেব। '

'এত ভাল একটা বাসা। এরকম বাসা খুজে পাওয়া যাবে?'

'না এটা ভাল বাসা নয়। এটা একটা ভুতের বাড়ি। '

'ঠিক আছে তুমি শান্ত হও। আমি কালই বাড়িওলাকে জানাব।'

'না তুমি এখনি জানাও।'

'ঠিক আছে এ বাসাটা ছেড়েই দেব। এই যে আমি এখনি ফোন করছি। '

হাসান দ্রুত বাড়িওলার বাসায় ফোন করল।


ভয় কাটাতে অনেক কৌশলই করল হাসান। কিন্তু শম্পার ভয় কাটে না। রাতে অনেক বুঝিয়ে বিছানায় শোয়াল তাকে হাসান কিন্তু ঘুর্নায়মান ফ্যান দেখে ভয় পেতে থাকল সে। আমি এখানে শুয়ে থাকতে পারবনা। ফ্যানটার দিকে চোখ গেলেই ভয় হচ্ছে। আহা এত ভয় পাচ্ছ কেন বলতো? আরে মেয়ে ভুত কখনো মেয়েদের ভয় দেখায়না। বাড়িওলার মেয়ের ভুতের তো আমাকে ভয় দেখানো উচিৎ। দুই হাত বাড়িয়ে আমার দিকে এগিয়ে আসা উচিত। ”এই হাসান দেখ। আমি তোর বউয়ের চেয়েও সুন্দরী।” - রাগের বিষয়টা হাল্কা করার জন্য এ রকম অনেক রসিকতা করার চেষ্টা করল হাসান। কিন্তু কোন কথাতেই কোন কাজ হল না। ফোনে ডাক্তার বন্ধুকে সংক্ষেপে ঘটনা জানাল হাসান। রাতটা অন্য ঘরে কাটানোর পরামর্শ দিল সে। ডাক্তারের কথানুযায়ি অন্য বেডরুমে ঘুমাতে গেল তারা। কিন্তু সারাটা রাত ঘুমাতে পারলনা শম্পা। রাতেও দুবার ঘুমের ঘোরে ভয়ে চিৎকার করে উঠল সে।


পাঁচ.

মোটামুটি বেশ সকালেই বাড়িওলা তার কথিত ’মৃত’ মেয়েকে সাথে করে উপস্থিত হলেন। হাসান আর শম্পা ওদের অভ্যর্থনা জানাল চোখে কালসিটে দাগ নিয়ে। রাতে মোটেও ঘুম হয়নি তাদের।

'কোত্থেকে এই আজগুবি তথ্য পেলেন আপনারা?'- রীতিমতো ক্রুদ্ধস্বরে চেঁচাতে লাগলেন তিনি।

'দেখুন আমাকে ভুল বুঝবেন না।' - হাসান গতকালের ঘটনা খুলে বলল। '

বাড়িওলা তক্ষুনি জমিলার মাকে ডেকে আনালেন। সে পাশের বাসায়ই কাজে ব্যাস্ত ছিল সে। ওকে দেখা মাত্রই 'এই বদমাশের বাচ্চা; আমার মেয়ের নামে কি বলেছিস' - বলে দ্রুত গালের মধ্যে চটকোনা মেরে বসলেন ভদ্রলোক!

শম্পা তারাতারি ওকে সরিয়ে নিয়ে পাশের ঘরে এল। ভদ্রলোক ওর গায়ে হাত দিয়েছে। অবশ্য দেবারই কথা। তার জলজ্যান্ত মেয়েকে কেউ আত্মহত্যা করে মরেছে বললে খারাপ লাগারই কথা।

শম্পার ভীষন রাগ হতে লাগল। তুমি কেন মিথ্যে কথা বললে বল। নাহলে আমিও মারব তোমাকে। পুলিশের হাতে তুলে দিব। সত্যি কথা বল।

'আফাগো আমারে মাফ কইরা দেন। কিল্লিগা কইছি আমার জানিনা। আমার মাথা ঠিক নাই। আমি আসলে কি কইতে কি কইছি বুঝি নাই।' - ভয়ে কাপা গলায় উত্তর দেয় জমিলার মা।

'তাই বলে তুমি আমাকে বলবে না যে কথাটা মিথ্যা? আমি মিছেমিছি এত ভয় পেলাম?'

'আমি বুজবার পারিনাই আফনে এত ডরাইবেন। আসলে হেয় আমারে কামে নিছিল কিন্তু হারাদিন খ্যাচখ্যাচ করতো আমার লগে। আবার যেইকামই করতাম কোনডাই তার পছন্দ হইতো না। হেয় আবার জামাইয়ের সাথে ঝসড়া ঝাটি করত হারাদিন। কি থুয়া কি কইতো তার কোন ইস্টিশন নাই। মাঝে মইদ্যে শুনতাম হেয় কইতো দেখ তুমি আমার সাথে বেশী ইয়ে করবা তো গলায় দড়ি দিয়ে ফ্যানের সাথে ঝুলে পড়ব। আমার মৃত্যুর জন্য তুমি দায়ী তা লিখে যাব। তখন বুঝবে মজা। সারাজীবন হাজতে কাটাতে হবে। '

জমিলার মা অঙ্গভঙ্গি করে এমনভাবে বাড়িওলার মেয়ের কথাগুলো অভিনয় করে দেখালো যে শম্পা না হেসে পারল না।

'হাইসেন না আফা। বেডির উপরে আমার দুনিয়ার রাগ। প্রতিদিন ঝগড়া বিবাদ হইতো আর আমি আশায় থাকতাম হেয় হয়তো একদিন ঝুইলা পড়বো। কিন্তুক ঝুলে নাই। তাই আপনার কাছে কইয়া আশা পুরন কইরা ফালাইছি। '

'এটা কোন কথা হল? ছিঃ' - পাশের বাসার ভাবীর সাবধানবানী মনে পড়ল। বুয়ার উল্টাপাল্টা কথা বিশ্বাস করে কি কান্ডটা হয়ে গেল!

বাড়িওলা কারো কথা শুনলেন না। ততক্ষনাৎ জমিলার মাকে বিতাড়িত করা হল। ভবিষ্যতে এই এলাকায় যেন না দেখা যায় তাকে সে ব্যাপারে সাবধান করেও দেয়া হল।

আর বাড়িওলার মেয়ের সাথে কথা বলে বেশ অবাকই হল শম্পা। এত ভদ্র নম্র তার ব্যবহার। অথচ জমিলার মা কি উল্টাপাল্টা কথাই না বলেছিল তাকে নিয়ে। তাকে নিয়ে এতবড় একটা রটনার পরও সারাটা সময় চুপচাপ বসে থাকতে দেখা গেল তাকে!


ছয়.

রাতে শুয়ে পড়েছে শম্পা। ফ্যানটা ঘুরছে মাথার উপর। আনমনে ঘুর্নায়মান ফ্যানটা দেখছিল সে। কোন ভয়ই লাগছে না এখন তার। সে ভাবছিল অন্য কথা। ’আচ্ছা দেখতো এখন কাজের লোক কোথায় পাব? দিল তো বেটিকে তাড়িয়ে।’ পাশেই আধশোয়া হয়ে টিভি দেখায় রত হাসানকে উদ্দেশ্য করে বলে শম্পা।

'আরে চেষ্টা করলে ওরকম আরও পাওয়া যাবে। বেশী চিন্তা কোরো নাতো; কালই আমি লোক লাগিয়ে দেব।' - চ্যানেল টিপে দর্শনযোগ্য অনুষ্ঠান বের করতে ব্যার্থ হয়ে বন্ধ করে দিল টিভিটা।

হঠাৎ পাশ ফিরে বলতে থাকে শম্পা। - ’তুমি ব্যাপারটা জান ভেবেই আমি আরো ভয় পেয়ে গেলাম; অথচ তুমি -’

’আমিতো বলেছিই আমি হাল্কা করতে চাইছিলাম ব্যাপারটা। তোমার মাথা থেকে ভুত তাড়াতে চাইছিলাম আরকি। আসলে তাৎক্ষনিকভাবে অন্যকিছু মাথায় আসেনি। ’

'অথচ তুমি অস্বীকার করলেই জমিলার মাকে আমার সন্দেহ হতো। আর এত ঘটনাও ঘটতো না। সেই সুযোগ তুমি আমাকে দাওনি। '

'যাক বাদ দাও - বেশ ভাল একটা শিক্ষা হল। তবে একটা ব্যাপার খেয়াল করেছো?' - হাসান আবার শুরু করে। 'গতকালও তুমি এ ঘরে থাকতে ভয় পাচ্ছিলে। ফ্যানটা ঘুরতে দেখে। অথচ আজ - '

শম্পা আবার তাকাল ঘুর্নায়মান ফ্যানের দিকে। নিরিহ ফ্যানটি ঘুরছে - ভয় লাগার কোন কারনই নেই।

'বাহ - ভয় পাবনা? কেউ সত্যিই ওখানে ঝুলে মরে গেলে ভয় পাবনা?'

'ও তারমানে ঘটনা সত্য হলে তুমি ভয় পেতে?'

'অবশ্যই পেতাম। '

'হু তবেই বোঝো - ভুত আসলে কোথায় বাসা বাধে?'

'তার মানে?'

'মানে বলতে চাইছি ভুতটা কোথায় বাসা বেধেছিল তা কি তুমি ধরতে পেরেছ?'

এইবার বুঝল হাসান কি বুঝাতে চাইছে। 'হু জানি। ভুতের বাড়িটা কোথায় ছিল তা আমি বুঝতে পেরেছি। '

'বলতো কোথায়?'

'এই যে এখানে ’আঙ্গুল দিয়ে নিজের মাথায় একটা টোকা মারল শম্পা। ’আমার মাথায়।’

'তাহলে? এই বাসায় থাকতে আর সমস্যা নেই তো? এটা ভাল বাসা নিশ্চয়ই?'

শম্পা মুচকি হাসল।

'তাহলে ভাল বাসায় আবার নতুন করে ভালবাসা শুরু হোক? কি বল?' - চোখ মেরে কিছু একটা ইঙ্গিত করে হাসান।

'জি নেহি জনাব। আপনার ইচ্ছে পুরন করতে পারছি না।' - মুখে একথা বললেও তার চোখে ষ্পষ্ট আমন্ত্রন দেখতে পায় হাসান। এই অদ্ভুত আচরন সবসময় কেন করে শম্পা তা বুঝতে পারে না হাসান। সব মেয়েরাই কি তাই করে? ভাবনাটা মনে আসতেই টিপ করে বেডসুইচ টিপে বাতিটার সাথে ভাবনাটাকেও নিভিয়ে দেয় সে। তারপর ’আমি ভুত; হাই মাই খাই’ - বলে জড়িয়ে চেপে ধরে শম্পার...


ধেত্তোরি, অন্ধকারে ওরা কি করলো না করলো তার আমি কি জানি...

শেষ বাস

এক.

'ভাই আর একটু জোরে চালা তো।'- আমি রিক্সাওলাকে তাড়া দেই। মফস্বল শহরে রাত বারটার দিকে বাস আশা করা ঠিক না। তার পরেও কেন জানি মনে হচ্ছে শেষ বাসটা হয়ত একটুর জন্য মিস করব। তাই এই তাড়াহুড়া। হয়তো শুনব একমিনিট আগে ছেড়ে গিয়েছে শেষ বাস।
বাস স্টেশন অন্ধকার, মনে হচ্ছে ইলেকট্রিসিটি নেই। মরার উপর খাড়ার ঘা আরকি! আশেপাশে তাকিয়ে কোন জনমানব চোখে পড়লনা। মনটাই খারাপ হয়ে গেল। আজ সকাল থেকেই কুফা যাচ্ছে। কাল সকালে ঢাকায় না পৌছুতে পারলে বিরাট ক্ষতি হয়ে যাবে।
রিক্সাওয়াল কে বিদায় করে দাড়িযে রইলাম। দেখা যাক, যদি কোন ট্রাকও পাই তাও রওনা হয়ে যাব আল্লাহ ভরসা করে।
অষ্পষ্টভাবে শব্দগুলো কানে যেতেই কান পেতে শোনার চেষ্টা করলাম। বাসের গায়ে চাপড় দিয়ে ডাকাডাকির শব্দ বলে মনে হল। আমি একটু সামনে এগুলাম। হ্যা, ঠিকই। বাসের হেলপার সম্ভবতঃ বাসের গায়ে জোড়ে চাপড়াচ্ছে আর প্যাসেন্জার ডাকছে। প্রায় সব বাসগুলোই এই কাজ করে। প্যাসেন্জার না পেলে স্ট্যান্ড থেকে একটু দুরে দাড়িয়ে ডাকাডাকি করতে থাকে। বেশী প্যাসেনজারের আশায়।
আমি দ্রুত এগুতে থাকি। 'এই বাস এই।' - আমি দু একবার হাকও দিলাম। 'আমাকে নিয়ে যাও। দাড়াও, আমাকে নিয়ে যাও।'
আশ্চর্য। যতই এগুতে থাকি মনে হয় বাস ঠিক তত দুরেই রয়ে গেছে। ছেড়ে চলে গেল নাকি? আমি হতাশ হয়ে দাড়াতেই আবারও শুনলাম বাস চাপড়ানোর শব্দ।
আমি আবছা অন্ধকারে এবার দৌড়াতে লাগলাম। 'এই দাড়াও এই দাড়াও।'
আমি এগুতে থাকি। আশ্চর্য। সেই একই ঘটনা। বেটা ড্রাইভার কি আমাকে নিয়ে ইদুর বেড়াল খোলা শুরু করল নাকি?
কতক্ষন দৌড়ালাম জানিনা। হঠাৎ বাসের গায়ে হুমড়ি খেয়ে পড়ে গেলাম। অন্ধকারে খেয়ালই করিনি।
বাসের ভিতরে কোন আলো নেই। দরজার সামনে গিয়েও কাউকে পেলাম না। কি ব্যাপার এই বাসটাই কি প্যাসেন্জার খুজছিল? নাকি অন্যটা।
বাসের গেটে পা দিতেই হঠাৎ যেন প্রান ফিরে পেল বাসটি। এক মুহুর্ত আগেও যেটাকে মনে হচ্চিল জনশুন্য। আমি উঠার পর হঠাৎ সে দৃশ্য পাল্টে গেল। আবার হেলপারের সেই ডাক। বাসের ভেতরে যাত্রীদের কথোপকথন। মাঝারি সাইজের বাস। ভিতর ১৮ থেকে ২০ জনের মত লোক হবে। সবাই যার যার মত বসে নিজেদের মধ্যে আলাপ করছে। আমি উঠে পিছনের দিকে গেলাম। একেবারে শেষ সিটটা একদম খালি দেখে ওখানে বসলাম। দৌড়ে ঘেমে গেছি। একটু রেস্ট নিয়ে নেই।
'এই যে ভদ্রলোক, এই' - কেউ আমার জামা ধরে টান দিল মনে হল! আমি জানালা দিয়ে উকি দিলাম। অন্ধকারে ঠিকমত দেখা যাচ্ছেনা। তবে বুঝলাম বাসের হেলপার আমাকে জানালা দিয়ে ডাকছে।
'কি হয়েছে'- আমি জিজ্ঞেস করি। সামনে মানুষের ছায়া। সম্ভবতঃ হেলপার।
'আপনে এই বাসে উঠছেন ক্যান? আপনে এই বাসে যাইতে চান কেন?' - জিজ্ঞেস করে ছায়ামুর্তি।
'কেন অসুবিধা কি? এটা কি রিজার্ভ বাস? দেখ আমি খুব সমস্যায় পড়েছি। আমার খুব যাওয়া দরকার' - আমি সাফাই গাইতে থাকি।
'আমরাই তিনদিন ধইরা যাইতে চেষ্টা করতাছি তা পারতাছিনা। আর আপনে আইজকা আইসাই যাইতে চাইতাছেন?' - কে যেন ভিতর থেকে বলে উঠল কথাগুলো। সম্ভবতঃ বাসের ভিতর থেকে কোন প্যাসেনঞ্জার।
'আপনি নামেন।' - হেলপার আমাকে তাড়া দেয়।
'দেখ আমাকে যেতেই হবে। দরকার হলে দ্বিগুন ভাড়া দেব। আর বাস তো খালিই পড়ে আছে। তোমাদের সমস্যা তো ঠিক বুঝলাম না।'
'সমস্যা আমাদের না। আপনারই হইবো। ভাল চান তো নামেন' - হেলপার বলে উঠে।
আমি পাত্তা দিলাম না। মাঝে মাঝে এরা এরকম ফালতু আচরন করে থাকে।
'আচ্ছা বাসটা এত দেরী করছে কেন?' বাসের ভিতরেই প্রশ্নটা ছুড়ে দিলাম।
'আমাদের আর একজন বাকি আছে। ও এখনো আইসা পৌছায় নাই।' - আবারো ভেতর থেকেই কেউ একজন বলে উঠল। - 'এই বুইড়ারে নিতে গিয়াই বাসটা দেরী কইরা ফালায়। সে জন্যই'- এপাশ থেকে দীর্ঘশ্বাসের শব্দ শোনা যায়। - 'তারপরও কেন যে বুইড়া দেরী কইরা আসে'
কি মুশকিল। প্যাসেন্জার বাস আবার একজনের জন্য দাড়িয়ে থাকে নাকি? আমি ভাবতে থাকি। আচ্ছা ডাকাত দল নয়তো! কিছুদুর গিয়ে বাস ডাকাতি শুরু করবে?
আমার কাছে তেমন টাকা পয়সা নেই। আসলে বলতে গেলে কিছুই নেই। তাই ভয় পাওযার কোন কারনই নেই। যা হবার হবে। পেছনেই বসে থাকব বলে ঠিক করলাম। বিপদ দেখলে জানালা দিয়ে পগার পার হতে চেষ্টা করব।
'ঐ খাড়া। আমি আইয়া পড়ছি।' - বাইরে কারো চিৎকার শোনা যায়।
একজন বৃদ্ধ। এর জন্যই কি এতক্ষন দেরী করল বাসটি? কারন বৃদ্ধ উঠতেই মূহুর্তে তুমুল বেগে ছুটে চলল বাস। ধীরে ধীরে বৃদ্ধ লোকটি বাসের পেছন দিকে চলে আসল। আমার ঠিক সামনের সিটে বসার আগে এক মুহুর্তের জন্য তার সাথে চোখাচোখি হল আমার। তার চোখ দেখে ভয়ানক চমকে গেলাম আমি। নির্জিব ঘোলা দুটি চোখ! মুহুর্তেই গাড়ীর ভেতরে অন্ধকার নেমে এল। খুব সম্ভবতঃ বাতি নিভিয়ে দিয়েছে ড্রাইভার! কিন্তু ঐ চোখ দুটো অমন কেন? ও কি অন্ধ?
আমি একটু তন্দ্রাচ্ছন্ন হয়ে পড়লাম। সারাদিনের ক্লন্তি ভর করল আমার উপর। কতক্ষন কেটে গেল জানিনা। হঠাৎ সম্পুর্নরুপে তন্দ্রার ঘোর কেটে গেল। চারিদিক নিঝুম অন্ধকার, কোন সাড়া শব্দ নেই। আমি যেন উড়ে চলেছি অন্ধকারে! চারিদিকে কিছু চোখে পড়লনা। আমি তো বাসের ভিতর থাকার কথা। বিষয়টা কি? দ্রুত উঠে দাঁড়াতেই আবার বাসের ভিতর আলো জলে উঠল। ঠিক আগের মত করে প্রান ফিরে পেল যেন বাসটি! ধেৎ, খুবসম্ভবতঃ ঘুমিয়ে স্বপ্ন দেখছিলাম।
আমি আবার ঘুমিয়ে পড়লাম। কতক্ষন ঘুমিয়েছি বলতে পারবনা। হঠাৎ জোরে হুইসেলের শব্দে কানে তালা লেগে গেল। ট্রেনের হুইসেল না? চারপাশে আবারো সেই অন্ধকার। চিৎকার চেচামেচির শব্দ শোনা যাচ্ছে। 'আরো জোরে যা, আরো জোরে' 'আইজকা পার হইতেই হইব' 'জোরে চালা' 'আমার আইজকা যাইতেই হইব' ইত্যাদি ইত্যাদি। হঠাৎ আমার সামনেই মনে হল সেই বৃদ্ধের গলা শুনলাম। - 'জোরে চালা বাবা, আইজকা পার কইরা দে বাবা, আইজকা পার কইরা দে।'
কানের কাছের ট্রেনের একটানা হুইসেল আরো বিকট হয়ে বাজছে। - 'অই ড্রাইভার, জোরে চালা।' - বুড়ো তাড়া দিচ্ছে ড্রাইভারকে। আমি আন্দাজে জানালার দিকে যাবার জন্য চেষ্টা করলাম। সংঘর্ষের বিকট আওয়াজটা কানে যাবার ঠিক আগমুহুর্তে বৃদ্ধের চিৎকার কানে বাজল 'আইজকাও পারলিনা হারামজাদা।'
তারপর আর কিছু মনে নেই।


দুই.

'ভাই আপনে কেডা? বাসের ভিতরে কি করেন?' - অস্পস্ট কন্ঠের আওয়াজ কানে যেতেই আমি ধরমরিয়ে উঠে বসলাম। কোথায় আমি?
মুখের উপর কেউ ঝুকে ছিল। আমি উঠে বসতেই সোজা হয়ে দাড়াল। ছেড়া গেন্জী গায় লুঙ্গি পরিহিত মধ্যবষস্ক একজন মানুষ।
চারিদিকে তাকাতেই অবাক হয়ে গেলাম। মুহুর্তেই মনে পড়ে গেল সব। একটা ভাঙা চোরা বাসের ভিতরে আধশোয়া আমি। বাস এ্যাক্সিডেন্ট করেছে। সৌভাগ্য আমার আমি বেঁচে আছি।
নিজের হাত পা নাক মুখ সব এক নজরে দেখে নিলাম। কপাল ভালো আমার কোথাও কোন চোট লাগেনি। তবে আশ্চর্য হলাম আমি ছাড়া আর কেউ ভিতরে নেই দেখে। সবাই বের হয়ে গেছে? আমি একাই পড়ে আছি?
লোকটির সাহায্য নিয়ে বাসের ভিতর থেকে বের হযে এলাম। রেল লাইনের ঠিক পাশে প্রায় দুখন্ড হয়ে রয়েছে বাসটি। পেছনের খন্ডে ছিলাম আমি। গতকাল রাতে এই বাসেই উঠেছিলাম আমি। দুমরে মুচড়ে গেলেও চিনতে পারলাম।
একটু সামনে রেল ক্রসিং দেখতে পেলাম। ট্রেনটি বাসটিকে এতদুর পর্যন্ত টেনে হিচড়ে নিয়ে এসেছে!
আশ্চর্যের ব্যাপার আশেপাশে কোথাও কেউ নেই। এতবড় দুর্ঘটনা ঘটে গেল আর কেউ এলনা এখানে? নাকি সবাইকে বের করে নিয়ে গেছে? আমাকে কেউ খেয়াল করেনি?
'আচ্ছা, বাসের অন্যান্য যাত্রীদের কি অবস্থা? কেউ কি মারা গেছে?' - আমি জিজ্ঞেস করি লোকটিকে।
লোকটি সন্দেহজনক দৃষ্টিতে তাকাল। আমার প্রশ্নের জবাব না দিয়ে উল্টো জিজ্ঞেস করল - 'আপনে কে কনতো? ভাঙ্গা বাসে ঢুকছিলেন ক্যান এত সকালে?'
'তুমি কে আগে সেইটা বল? বাসের সব যাত্রীরাই বা কোথায় গেল?' - আমি আসলে কিছুই মেলাতে পারছিনা।
'দেখেন মালিক সাব আমারে বাসের পাহারাদার বসাইছে। কেউ যাতে কিছু চুরি না কইরা নিয়া যায় সেইটা দেখার জন্য। আপনেরে দেইখা তো ভদ্রলোকই মনে হইতেছে। বাসে উঠছিলেন ক্যান সেইটা কন'
এই ব্যাটার আচরন রহস্যময়। কিছু একটা গুব্লেট হয়ে গেছে মনে হচ্ছে। - 'আরে বোকা তুমি বুঝতে পারছনা গাড়িটা রাতে এক্সিডেন্ট করেছে আর আমি ভাগ্যগুনে বেচে গেছি।' - আমি বোঝানোর চেষ্টা করি লোকটিকে।
আবারো অদ্ভুত সন্দেহজনক দৃষ্টিতে তাকাল লোকটা আমার দিকে। - 'দেখেন উল্টাপাল্টা কথা কইয়েননা। তিনদিন ধইরা গাড়ীর ভিতরে পইরা রইছেন আর কেউ দেহে নাই কইবার চান?'
এনবার আমার অবাক হবার পালা। 'তিনদিন মানে? আমিতো গতকাল রাতে বাসে উঠেছিলাম।' - আচ্ছা এই লোক উল্টাপাল্টা কথা বলছে কেন। আমি চারিদিকে আর কেউ আছে কিনা দেখলাম।
'আফনে আহেন তো আমার সাথে। মাস্টারের সাথে কথা কই।' - লোকটি আমার হাত টানতে লাগল।
'মাস্টারটা আবার কে?' - আমি ঝটকা দিয়ে হাত ছাড়িয়ে নিলাম। ব্যাটা একটা আস্ত পাগল।
'ঐ যে' -আঙ্গুল তুলে ক্রসিংএর পাশে রেলএর ঘরটা দেখাল।- 'চলেন লাইন মাস্টারের লগে কথা কই।'
গুড আইডিয়া। এই পাগলের সাথে কথা বলার চেয়ে মাস্টারের সাথে কথা বলাই উত্তম। আমিও রাজি হলাম।
'কিরে ব্যটা রমজাইন্যা ডাকস ক্যান' - লোকটির ডাকে ভিতর থেকে রেলের পোষাক পরা একজন - খুব সম্ভবতঃ ক্রসিংএর ডিউটিরত গার্ড হবে - বের হয়ে এল।
'দেখেন এই লোক' - আমার দিকে আঙ্গুল তুলে দেখাল সে - 'আমাগো গাড়ির পিছে শুইয়া আছিল সক্কাল বেলা। হেয় কয় হেও এক্সিডিন হইছে।'
আশ্চর্য! সেও সন্দেহজনক দৃষ্টিতে তাকাল আমার দিকে। - 'আপনেরে দেইখা তো ভদ্রলোক মনে হয়। কি করেন আপনে?'
আমি বল্লাম। সব শেষে এও বল্লাম যে, গতকাল রাতে ঐ বাসে ছিলাম আমি এবং এক্সিডেন্ট এর কবলে পড়েছি।
ওরা দুজন মুখ চাওয়া চাওয়ি করল। - 'কথা সইত্য।' - লোকটি বলতে শুরু করল। - 'এক্সিডিন হইছে। গার্ডের ভুলের কারনে খুব খারাপ এক্সিডিন হইছে। থানা পুলিশ অনেককিছু হইয়া গেছে। কিন্তু সেইডাতো গত পরশুদিন। ১০তারিখ রাইতে। আর আইজতো ১৩ তারিখ তাইনা?'
সত্যিই আজ তের তারিখ। গতকাল সন্ধায় জরূরী ফোন আসে ঢাকা থেকে। রাতেই যেতে হবে। গতকাল ১২ তারিখ উপজেলা লেভেলে বড় একটা প্রোগ্রাম হয়েছে আমাদের প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে। গত এক মাস ধরেই এই ১২ তারিখ আমার মুখস্ত।
আমার নীরবতা দেখে লোকটি আবারো বলতে শুরু করল - 'আর গতরাইতে এতবড় এক্সিডেন্ট হইলে এইখানে মানুষ থাকতো না? আর লাশগুলা গেল কই? এত তাড়াতাড়ি উধাও হইয়া গেল?'
এবার আমার অবাক হবার পালা। - 'লাশগুলো মানে? লোকজনও মরেছে নাকি?'
'এতবড় একটা এক্সিডিন। মানুষ মরবো না? এয় কয়কি? এইখান থাইকা ছেঢ়ড়াইয়া বাসটা দুইটুকরা কইরা ফালাইলো আর আপনে' - হতাশ শোনাল লোকটির গলা।
আসলে সত্যিই। বেশ বড় এক্সিডেন্টই হয়েছে। রাতের ঘটনা একটুমনে করার চেষ্টা করলাম। ট্রেনের দ্রুত হুইসেল, বাস ট্রেন সংঘর্ষেও শব্দ, চিৎকার, কান্না - তারপর আর কিছু মনে নেই। কিন্তু এতবড় দুর্ঘটনায় আমার কিছুই হলনা? অবাক হয়ে ভাবি আমি। কোথাও একটু ছড়েও যায়নি আমার। আশ্চর্য!!
'হায় কপাল এ কিয়ের মইধ্যে পড়লাম সক্কাল বেলা' - দেখি রমজান নামের লোকটিও অদ্ভুত দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে।
'খাড়ান খাড়ান, এক মিনিট। আপনেরে একটা জিনিস দেখাই।'
লোকটি মুহুর্তেও মধ্যে ঘরে ঢুকে একটা দৈনিক পত্রিকা নিয়ে এল। - 'আইজ তো ১৩ তারিখ তাইনা? এইযে দেখেন ১১ তারিখের পেপার।' - আমাকে পত্রিকার তারিখটা ভাল করে দেখিয়ে নিল আগে।
দেখছেন তারিখ? এবার দেখেন। পুরো পত্রিকা মেলে ধরল সে। হেডিং দেখে তাজ্জব বনে গেলাম। মর্মান্তিক সড়ক দুর্ঘটনায় ১৭ জন নিহত।
ঠিক নিচেই প্রকাশিত ছবিটা দেখে শিউরে উঠলাম আমি। সারি সারি লাশের ছবির; ইনসেটের ছবিটা চিনতে এতটুকু কষ্ট হলনা। সেই বৃদ্ধের মুখ - যে শেষ মুহুর্তে ড্রাইভারকে লক্ষ করে বলে উঠেছিল - 'আইজকাও পারলিনা হারামজাদা।'

মামা (পর্ব ১)

১.

'এই দাঁড়া! তুই সঞ্জু না?' - বাজখাই কন্ঠ শুনে ভীষন চমকে উঠলাম। আমি অবশ্য বাজখাই কন্ঠের কারনে এতটা চমকাইনি। এই বিদেশ বিভূঁইয়ে কেউ আমাকে নাম ধরে ডাকতে পারে তাও আবার মাতৃভাষায় - কখনো ভাবতেই পারিনি। সে কারনেই এত চমকে উঠা।
ফিরে তাকিয়ে দেখি বিশালদেহী এক ভদ্রলোক। গায়ে সাদা টি সার্ট, জিন্স প্যান্ট। খুবই চেনা চেনা লাগছে। কে যেন, কে যেন - সহসাই তাকে চিনতে পারলাম।
'আপনি সাধু মামা ঠিক?' - কিছুটা সন্দেহমাখা কন্ঠে আমার জিজ্ঞাসা।
'হু চিনতে পেরেছিস তাহলে। তা এখানে এসেছিস কেন?' -মামা জিজ্ঞেস করলেন।
'আপনি এখানে মানে এদেশে? ক-ক-কবে এসেছেন?' - অতি উৎসাহে আগ্রহে আমার তোতলামী শুরু হয়ে গেল। উনি কি বল্লেন তা আর আমার মাথায় ঢুকল না। আমি আসলে ভয়াবহ রকমের আশ্চর্য হয়েছি। দেশ থেকে হাজার মাইল দুরে সুদুর ইটালীর রোম শহরের কোন এক সমুদ্র পাড়ে যদি একান্ত কাছের কোন লোকের দেখা মিলে - কোনরকম পুর্ব যোগাযোগ ছাড়াই! তাহলে কেমন লাগতে পারে! আর উনি যে এদেশে তাতো কেউ আমাকে বলেনি! একেই কি কাকতালীয় ব্যাপার বলে!
'আমি তো এদেশেই থাকি। কেন তুই জানতি না?' - মামাও কিছুটা বিষ্মিত মনে হল।
'আমিতো জানতাম আপনি আর্মিতে আছেন।' - আমি বলতে থাকি। - 'কিন্তু এদেশে যে আছেন তাতো জানতাম না।'
'আর্মিতে ছিলাম ঠিকই কিন্তু সে তো বেশ কয়েক বছর আগের কথা।'- মামা বলতে লাগলেন। - 'এদেশে আছি তাও বছর দুয়েক তো হবেই।'
তারপর বীচে হাটতে হাটতে মামা আরো অনেক কথাই বললেন। বসনিয়ায় মিশন শেষে ইউরোপ ভ্রমনের সুযোগ পায় মামা। তারপর ইটালীতে থেকে যাওয়া।
'তা তুই এখানে কেন এসেছিস বললিনাতো?' - মামা হঠাৎ প্রসঙ্গ পাল্টালেন।
'এই অফিসের কাজে এসেছি।'
'অফিসের কাজে? তাই নাকি? আমিতো ভাবলাম দালাল মারফত পালিয়ে এসেছিস। হাঃ হাঃ' - মামা একটু হাসলেন। 'তা কি অফিস তোর?'
আমি জানালাম।
'আরেব্বাহ্, তুই তো অনেক বড় চাকুরী করিস দেখছি।'
'না এই আরকি।' - ভাবটা একটু বজায় রাখার চেষ্টা করলাম। যদিও বসের - বলা যায় 'দয়ায়' আমার এই ট্রিপ; ওয়ার্কসপের মুল পার্টিসিপেন্ট আমার বস, তবুও সবকিছু ভেঙ্গে বলার প্রয়োজন বোধ করলাম না।
'আপনি কোথায় থাকেন? মানে আপনার বাসা কোথায়?' - আমি জিজ্ঞেস করি। সঙ্গী সাথীহীন কিভাবে কাটাব এ আশঙ্কা ছিল শুরু থেকেই। ইটালীয়ান বসের সাথে এসেছি। সে নিজের বাড়িতে উঠেছে। আর আমি হোটেলে। মামাকে পেয়ে বেশ খুশী লাগছে। সময় কাটানো যাবে তার সাথে।
'আমিতো এখানেই থাকি। বিচে ঘোরাঘুরি করি। হাঃ হাঃ' - মামা রহস্যময় হাসি হাসলেন।
'তা তুই কোন হোটেলে উঠেছিস।' - মামা উল্টো আমাকে প্রশ্ন করে বসলেন।
আমি জানালাম।
'শেষ কবে দেশে গিয়েছেন?' - আমিও প্রসঙ্গ পাল্টাই।
'মনে নেইরে সত্যিই মনে নেই।'- একটু উদাসী কন্ঠে বলতে থাকেন তিনি।
তাই নাকি? খুব ব্যস্ত থাকেন মনে হয়?
'আমার আবার ব্যাস্ততা কিরে? ঘুরি ফিরি-'
'বাড়িতে রেগুলার যোগাযোগ হয় তো?'
'আমার আবার বাড়িঘর আছে নাকি। কেউ নেই আমার।' - উদাসী কন্ঠে বলতে থাকেন মামা।
মনে হচ্ছে বাড়িতে মামীর সাথে ঝগড়া ঝাটি হয়েছে। নইলে কিছু বলতে চাচ্ছেন না কেন। যাই হোক আমিও আর ঘাটালাম না তাকে। মামার সাথে এটা সেটা নিয়ে আলাপ করতে লাগলাম। তবে তিনি তার বাসায় নিয়ে যাবার ব্যাপারে কোন আগ্রহ দেখালেন না। আমিও আর সে প্রসঙ্গ উঠালাম না। তিনি না চাইলে আমারও অত ইচ্ছে নেই।
'এই তুই এখানে একটু বসতো। বসে বাতাস খা। আমার খুব জরুরী একটা কাজ করতে হবে। আমি আজ যাই।' - মামা হঠাৎ অপ্রাসঙ্গিক ভাবে তিনি উঠে দাড়ালেন।
'কিন্তু মামা' -- আমি শুরু করতেই তিনি বাধা দিয়ে বলতে শুরু করলেন।
'তুই তো এই সপ্তাহ থাকবিই তাইনা। আবার দেখা হবে।'
আমাকে অবাক করে দিয়ে তিনি হনহন করে হেটে চলে গেলেন।
কিছুক্ষন কিংকর্তব্যবিমূঢ হয়ে দাড়িয়ে রইলাম। তার আচরন কোনভাবেই মেলাতে পারলাম না। বেশ কিছুক্ষন মামার জন্য অপেক্ষা করলাম। কিন্তু তিনি এলেন না। সুর্য ডুবে গেছে অনেক আগেই। আমি হোটেলে ফিরে গেলাম। তার অদ্ভুত আচরনের কথা ভেবে অবাক লাগছে। উনি কেন হঠাৎ করে চলে গেলেন?
রাতে হঠাৎই একটা ব্যাপারে একটু খটকা লাগল। মামা আমাকে চিনলেন কিভাবে? উনি দুর সম্পর্কের মামা হলেও একসময় উনাদের সাথে আমাদের খুবই ঘনিষ্ঠতা ছিল।
'শেষ কবে দেখা হয়েছিল তার সাথে?' - ভাবতে থাকি আমি। যতদুর মনে পড়ে ১৮/২০ বছর আগে একবার গ্রামে বেড়াতে গিয়ে উনাকে দেখেছিলাম। তার পর আর - নাহ্; আরতো দেখা হয়েছে বলে মনে পড়ছে না। কিন্তু তখন তো আমি বেশ ছোট ১৫/১৬ বছর হবে বয়স। একটু ভাবতেই বুঝলাম আর তার সাথে দেখা হয়নি আমার। তবে নিয়মিত তার ছবি দেখা হত। সেকারনেই তাকে চিনতে পেরেছি। আর তার চেহারা, শরীর সব আগের মতই আছে। কিন্তু এতদিন পড়ে উনি আমাকে চিনলেন কি করে? ব্যাপারটা খুবই আশ্চর্যজনক মনে হল আমার কাছে।
ওয়ার্কসপের দিনগুলো অনেক ব্যস্ততার মধ্যে কাটল। বিকেলে বিকেলে অফিসের ব্যবস্থাপনায় ইটালীর বেশ কটা শহর ঘুরে দেখলাম। পিসার হেলানো টাওয়ারটাও দেখতে গেলাম একদিন। বিচে আর যাওয়া হল না। তবে প্রতিদিনই হোটেলে ফিরে কেউ আমাকে খুজেছে কিনা সেটা জানার চেষ্টা করতাম। কিন্তু আমার খোজে কেউ আসেনি ভেবে আশ্চর্য লাগত। মামা একবার এলেনও না? তিনি তো জানেন আমি এই হোটেলে আছি।
দেশে ফেরার আগেরদিন আবার হাটতে হাটতে সেই জায়গায় গিয়ে বসলাম। যেখানে মামা আমাকে ফেলে চলে গিয়েছিলেন। বসে বসে ভাবছিলাম মামার সাথে আজ দেখা হলে কিছু কটু কথা বলব। কিন্তু তিনি এলেননা। রাত আটটা পর্যন্ত অপেক্ষা করে মনে একরাশ দু:খ নিয়ে হোটেলে ফিরে এলাম।


২.

দেশে ফিরে তার কথা ভুলেই গিয়েছিলাম। কিন্তু সাপ্তাহিক ছুটিতে বাড়ি গিয়ে তার কথা মনে পড়ল।
'আচ্ছা মা সাধু মামার লেটেস্ট খবর জানো?' - আমি মা'কে জিজ্ঞেস করলাম।
মা আশ্চর্য হয়ে আমার দিকে তাকালেন। আমার প্রশ্ন বুঝলেন কিনা জানিনা। তিনি অস্ফুট কন্ঠে বলতে শুরু করলেন - 'আহা বেচারা। মিশন শেষ করে ইটালীতে পালিয়ে যায় সে। তারপর কিভাবে যেন দুষ্ট লোকের পাল্লায় পড়ে নেশার ব্যাবসা শুরু করে। ঐ যে কি যেন নাম। যায়গাটার। ফুমিচিনো না কি--'
'তাই নাকি? নেশার ব্যবসা- মানে ড্রাগ বিজনেস!!' - আমি আশ্চর্য হলাম মা'র কথায়। আমি এসবের কিছুই জানতাম না! তার রহস্যময় আচরনের কারন কিছুটা হলেও অনুমান করতে পারলাম। কেনইবা তিনি পরে আর দেখা করেননি আমারসাথে। কেন তার বাসায় আমাকে যেতে বলেননি।
'মামা কি এখন আর দেশে যোগাযোগ করেন না?' - আমি মাকে জিজ্ঞেস করি।
মা মনে হল কিছুটা অবাক হলেন। 'তোকে মনে হয় কেউ জানায়নি। গত বছর এই মাসের' - মা একটু চিন্তা করতে লাগলেন। - 'কত তারিখ মনে নেই। তবে এই মাসেই। বিচের উপর তার লাশ পাওয়া যায়। কারা যেন মেরে ফেলে রেখেছিল।'
'কি বলছ এসব? মামা মরে গেছেন নাকি?' - আমি স্তম্ভিত হয়ে গেলাম।
'হ্যা তাইতো বলছি তোকে। এইতো কয়েকদিন আগেই না ওরা সাধুর মৃত্যুবার্ষিকী পালন করল?'
'মৃত্যুবার্ষিকী!!' - আমি আশ্চর্য হয়ে গেলাম। 'কত তারিখে বলতে পার?' - অবচেতন মনে কি যেন একটা রহস্যের গন্ধ পাচ্ছি কিন্তু মেলাতে পারছি না।
মা একটু ভাবলেন তারপর তারিখটা বললেন আমাকে। আমার সারা শরীরের রোম মুহুর্তে দাড়িয়ে গেল তারিখটা শুনে। আমি স্তব্ধ হয়ে বসে রইলাম। একই দিনে সাধু মামার সাথে আমার দেখা হয়েছিল সে কথা আমি আর মা'কে বলতে পারলাম না।

মামা (পর্ব-২)

(বি.দ্র.: আগের পর্ব পড়া থাকা আবশ্যক)
আমি ভুত প্রেত বিশ্বাস করি না। অলৌকিক কোনকিছুতেও আমার বিশ্বাস নেই। আমি জানিনা যারা এসবে বিশ্বাস করেন তারা কেন করেন। হয়তো কারো জীবনে এধরনের অভিজ্ঞতা হয়েছে। আর কেউ কেউ হয়তো কোন কারন ছাড়াই চিত্তের দুর্বলতার কারনে এসব বিশ্বাস করে থাকেন। তবে আমার জীবনে যেহেতু এ ধরনের কোন ঘটনা ঘটেনি তাই আমিও এসব বিশ্বাস করি না। মামার মৃত্যুর ঘটনাটা আমার কাছে একটা রহস্য বলে মনে হচ্ছে - এটাকে অলৌকিক বা অদ্ভুতুড়ে ঘটনা বলে মানতে পারছি না। জলজ্যান্ত একটা মানুষ আমার সঙ্গে কথা বললেন হাসাহাসি, রসিকতা করলেন। যে কিনা মৃত! এ হতে পারে না। আমি এ বিষয়টার একটা তথ্য সংগ্রহে করব বলে ঠিক করলাম। একটা ব্যাপার বেশ ভাল হয়েছে; মামার সাথে আমার দেখা হবার ব্যাপারটা কাউকে জানাইনি আমি; আপাতত কাউকে জানাবও না বলে ঠিক করলাম। এতে করে আমার কাজ করতে সুবিধা হবে।
পরদিন সকালে নাস্তা সেরে বাইরের ঘরে বসে বিরক্ত ভঙ্গিতে টিভি চ্যানেল ঘুরাচ্ছিলাম। ভাবছি মামার বাড়িতে যাব। এমন সময় কেউ এলো-
'কে এইটা - সন্জু না?'
মহিলা কন্ঠ শুনে আমি মুখ তুলে তাকালাম। সাদা শাড়ী পড়া মাঝবয়সী মহিলা। চিনতে পারছি না। এই সমস্যায় হরহামেশাই পরি আমি। অনেকদিন পর পর বাড়িতে এলে আমি কাউকে চিনতে পারি না। অথচ সবাই আমাকে চিনে। এটা ওটা জিজ্ঞেস করে। আমি বিব্রত হয়ে উত্তর দিতে থাকি। না চেনা পর্যন্ত সংকোচ কাটে না।
আমি বোকার হাসি হেসে মাথা উপর নীচ করি দুইবার; চোখে জিজ্ঞাসু দৃষ্টি। অর্থ্যাৎ আমিতো সঞ্জু কিন্তু আপনি কে?'মি নাকি ইটালী গেছিলা?'ততক্ষনাত মামীকে চিনতে পারলাম। তাড়াতাড়ি উঠে মামীকে সালাম করলাম।'জি মামী এই সাতদিনের জন্য আরকি।'
মামী আমার পিঠে হাত বুলালেন। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। আমি ইটালী ঘুরে এসেছি বলেই কি আমার সাথে দেখা করতে এসেছেন? তার স্বামীর শেষ আবাসস্থল থেকে ঘুরে আসা ব্যক্তিকে তার কোন কারনে দেখতে ইচ্ছে করছে? দেখি মামীর চোখ ভিজে উঠেছে। এইনা মেয়ে জাতি!
আমি মামীকে ধরে সোফায় বসালাম। 'তারপর মামী কেমন আছেন? টুসী ওরা কেমন আছে?' - আমি দ্রুত প্রসঙ্গ পাল্টানোর চেষ্টা করি। এখন মামার বিষয়ে আলাপ শুরু করলে নির্ঘাত কান্নাকাটির আসর শুরু হবে। আর সাথে যদি মা’ যোগ দেন তবে তো কথাই নেই। রীতিমত বিলাপ শুরু হবে। মা’ আবার কান্নাকাটিতে বেশ এক্সপার্ট বলা যায়।
'আমাদের খবর নিয়া আর কি করবা? কেমনেই থাকি; খোজখবরও তো নেও না।' - রীতিমত অভিযোগ করে বসলেন তিনি।'না মানে একটু বেশী ব্যস্ত থাকতে হয়তো' - আমি সাফাই গাই।'হ, তোমরা বড় হইছ। বিয়া সাদী কইরা ব্যস্ত হয়ে গেছ। কেমনেই আর খবরাখবর নিবা আমাদের। মাঝে মাঝে আসলেও তো পার।'
এই সময় মা ঢুকলেন। 'টুসীর মা আসছ?'
আমি দ্রুত মা’র কাছে ফ্লোর দিয়ে পাশের ঘরে চলে এলাম। অস্বস্তিকর লাগে আমার এইসব বিষয়ে আলোচনা করতে। তবে মামার বিষয়ে জানতে মামীর সাথে তার বাড়িতে যাওয়া দরকার। মামী যেহেতু এসেছেন তার সাথে চলে যাব ভাবছি। আরে কিছু বিষয়ে জানা দরকার। কিন্তু কিভাবে শুরু করব এটাই বুঝতে পারছি না। মামার মৃত্যু নিয়ে ঘাটাঘাটি করছি এ ব্যাপারটাই বা মামী কেমন ভাবে নেবেন? গতরাতে মা’র কাছ থেকে মামার বিষয়ে অল্পই তথ্য পেয়েছি। মামার মৃতদেহ দেশে আনা নিয়ে নাকি বেশ সমস্যা হয়েছিল। সময়ও লেগেছিল বেশ কয়েকদিন। তবে মা বিস্তারিত কিছু বলতে পারেননি।
মামী ফেরার সময় আমাকে উনার বাড়ি যেতে বললেন। 'তুমি তো ফাঁকি দিলা। কোন কথাবার্তাই হইল না তোমার সাথে। চল যাই - দুপুরে খাওয়া দাওয়া কইরা আবার চইলা আইস।'
মা’ও যাবার জন্য বললেন। 'তোরা মাঝে মাঝে এসে চলে যাস। আত্মীয় স্বজনদের বাড়িও তো যেতে হয়। যা ঘুরে আয়।'
আমি 'ঠিক আছে কি আর করা' ভাব নিয়ে মামীর সাথে চলে এলাম। এটাই তো চাচ্ছিলাম আমি!
ছোটখাট একতলা বাড়ী মামার। পুরো বাড়ী জুড়ে আম কাঠালের গাছ; বেশ কিছু মেহগনী গাছও চোখে পড়লো - বেশ বড় বড় হয়ে গেছে। সামনে ছোট্ট পুকুরের মত; পুকুর ঠিক বলা চলেনা। বোঝা যায় ওখান থেকে মাটি উঠিয়ে বাড়ীর ভিটা তৈরী করা হয়েছে। যার ফলে ঐ পুকুর নামক ছোট ডোবার উৎপত্তি। বেশ কিছু অংশে শব্জী চাষও করেছেন মামী। আর পুরোটা বাড়ী টিন দিয়ে ঘেরা। বিয়ের পর থেকেই এখানে বসবাস তাদের।
মামী আমাকে ঘরে বসিয়ে ভিতরে চলে গেলেন। বেশ অগোছাল ঘর। জিনিসপত্রে ধুলোর আস্তরন। বেশ কিছু কাপড় চোপড় এদিক ওদিক ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে আছে। দেয়ালে তাকাতেই মামার বাঁধানো পোট্রেট চোখে পড়ল। সেই চেহারা - বিশাল গোঁফ। যেমন দেখেছিলাম তাকে সেদিন। এই গোঁফের কারনেই তাকে ছোটবেলায় আমরা অনেক ভয় পেতাম।
মামী অনেকগুলো ছবির এলবাম নিয়ে এলেন। 'সুজন তো বাড়ি নাই। সকালে কোথায় যেন গেছে। তুমি বইসা বইসা ছবি দেখ। এইটা টুসীর বিয়ের ছবি।' একটা এলবামের দিকে ইঙ্গিত করলেন মামী। বিশাল সাইজের ছবির এলবামগুলো। 'আমি তোমার জন্য খাবারের ব্যাবস্থা করি। '
মামীর বড় মেয়ে টুসী। শেষবার যখন দেখেছি তখন বেশ ছোট ছিল। অথচ এখন বিয়েও হয়ে গেছে। কত দ্রুত সময় চলে যায়! তারমানে সুজনও নিশ্চয়ই অনেক বড় হয়ে গেছে।
তবে টুসীর এ্যলবামের প্রতি আমার কোন আগ্রহ হল না। ওটা আলাদা সরিয়ে রাখলাম। অন্যগুলো থেকে একটা দেখতে লাগলাম। প্রবাসী ব্যাক্তির পরিবারের সবচেয়ে প্রিয় বস্তু মনে হয় ছবির এলবাম। প্রিয় মানুষের অবর্তমানে ছবিই হয়ে উঠে তাদের আনন্দের উৎস। ঘর অগোছাল হলে কি হবে। এলবামের প্রতিটি ছবিই যত্ন করে রেখে দিয়েছেন মামী। সবগুলোতেই মামার ছবি।
অনেক ছবিই কমবেশী পরিচিত মনে হল। আমার দেখা; আমাদের বাড়ির এলবামে রয়েছে সম্ভবতঃ। একটা এলবামের কয়েকটা ছবি দেখে অবাক হলাম। পরিবারের গ্রুপ ছবি। মনে হচ্ছে বেশ আগের ছবি। কিন্তু মামীর সাথের লোকটিকে ঠিক মামা বলে মনে হচ্ছে না। মামার বিখ্যাত গোঁফ নেই ঐ ছবিতে। অল্পবয়স্ক বালকের মত লাগছে তাকে!
আমি মামীকে ডাকলাম। এটাকে মামার ছবি মনে হচ্ছে না আমার কাছে। তিনি তো তার গোফ কাটার পাত্র নন!
মামীকে দেখাতেই তিনি একটু হাসার চেষ্টা করলেন। 'ঐটা ছিল পাগলামী। প্রথম মিশনে যাবার খবর পেয়ে পাসপোর্ট করার সময় সে মোচ কেটে ছবি উঠায়। আমি অবশ্য নিষেদ করেছিলাম। কিন্তু বিদেশ যাবে সেই আনন্দে মোচ কেটে ফেলেছিল তোমার মামা। বিদেশে যাবে তাই চেহারা ভদ্র করার জন্যই নাকি মোচ কেটে ফেলার প্রয়োজন ছিল।'
তবে বোঝা যাচ্ছে তার 'ভদ্র' ভাবখানা তিনি বেশীদিন বজায় রাখেননি। অল্প দুএকটা ছবি পাওয়া গেল এলবামে। গোফ ছাড়া - মিশনে যাবার পরপরই তোলা। যে ছবিগুলো আমি কখনো দেখিনি। খুব সম্ভবতঃ তিনি অল্প কিছুদিন পরেই আবার গোঁফ রাখতে শুরু করেন।
পাসপোর্টের কথা উঠতেই আমি মামীর দিকে তাকিয়ে একটু আমতা আমতা করে জিজ্ঞেস করি 'মামার পাসপোর্টটাকি এখনো আছে?'
মামী আমার দিকে একমুহুর্ত তাকালেন। তারপর ভেতরের ঘর থেকে একটা বড় সাইজের খাম নিয়ে এলেন। 'এইটার মধ্যে সব আছে। শেষবার তোমার মামার সাথে এইটাও আসছিল।' কথা ভারী হয়ে এল মামীর - বুঝলাম মামার কফিনের সাথে সম্ভবতঃ এই খাম এসেছিল। তাই মনে পড়েছে মামীর। একটু খারাপই লাগল তাকে পুরোনো ঘটনা মনে করিয়ে দেবার জন্য।
মামার মৃত্যু পরবর্তী কাগজপত্র এগুলো। তার মিশন সংক্রান্ত অনেক ডকুমেন্টও পাওয়া গেল। আমি ভিতরের সবগুলো কাগজপত্র বের করে খুটিয়ে খুটিয়ে দেখলাম। তবে কোন রকম সন্দেহজন কিছু চোখে পড়ল না। একটা বিষয়ই একটু খটকা লাগল। পাসপোর্ট বা অফিসিয়াল সব কাগজপত্রে তিনি একটি মাত্র ছবিই ব্যবহার করেছেন। সেটি তার গোঁফবিহীন ছবি।
(চলবে...)

আমার ব্লগ জীবন

আমি যে ব্লগিং করি বা গল্প লিখি তা অনলাইন পাঠক ছাড়া আর কেউ জানত না এতদিন। এমনকি আমার স্ত্রী ও জানেন না! গত সপ্তাহে আমার কলিগ (পাশের ডেস্কের - আমার সবচেয়ে কাছাকাছি) প্রথম জানতে পারেন আমি গল্প লিখেছি কয়েকটা। (উনি অবশ্য ব্লগিং এর ব্যাপরে আমাকে 'রিড-অনলি' পাঠক হিসাবে জানতেন। সে রকম ধারনাই দিয়েছিলাম তাকে।) কলিগকে যখন জানিয়েছিলাম আমি কয়েকটা গল্প লিখেছি তখন উনি একটু অদ্ভুত দৃষ্টিতে তাকিয়েছিল। (আমার মত লোক গল্প লিখে!)
তো সেদিনই যাদুকর গল্পটি প্রকাশিত হয়েছিল। আমি উনাকে যাদুকর গল্পের লিংটি দিলাম। উনি প্রথম দু তিনটি প্যারা পড়েই 'আরে আপনি তো দারুন লিখেন!' বলে অতি উৎসাহে দ্রুত দাড়িয়ে হাত বাড়িয়ে দিলেন আমার সাথে হ্যান্ডশেক করার জন্য! বোঝা গেল উনি আমার এহেন কর্মকান্ডে বেশ উত্তেজিত এবং বিষ্মিত! তারপর তিনি সবগুলো লেখাই একে একে পড়ে ফেললেন।
কলিগের সাথে কেনজানি আমার সবসময় টানপোড়ন চলতে থাকে। কিছুটা মিল মহব্বত, কিছুটা মনমালিন্য এভাবে দুজনেই একে অপরের উপর 'মনুষত্ব' ফলাই। বাসায় স্ত্রীর সাথে যেমন সবসময় খুনশুটি, রাগারাগি, দৈনন্দিন আলাপচারিতা বা চিৎকার চেচামেচি করে 'মনুষত্ব' দেখাই ঠিক সেরকমই। স্ত্রীর পর তিনিই আমার একেবারে কাছাকাছি ব্যাক্তি! সপ্তাহের পাঁচ দিন যে ব্যাক্তি আমার সাথে প্রায় ৪৫ ঘন্টা সময় ব্যায় করে সেতো আমার অতি নিকটজনই! তার সাথে 'মনুষত্ব' জাহির করবো নাতো কার সাথে করবো?
যাই হোক গল্পগুলো পড়ার পর উনার পাল্লায় আমার ওজন কিছুটা বেড়ে গেছে মনে হল। গল্পোত্তর ব্যবহারে আমার তাই মনে হচ্ছে। বেশ কয়েকদিন পর আবার দুজন একসাথে চা খেতে গেলাম বাইরে।
অফিসের প্রায় সবার কাছেই আমি একজন 'কম্পিউটার বিশেষজ্ঞ'। সবজান্তা ধরনের লোক। (উলুবনে শেয়াল রাজার মত আরকি!) সেদিনই বিকেলের দিকে আমার আরও একজন কলিগ আমারকাছে টেকনিক্যাল হেল্পএর জন্য এলেন। কি ভেবে তাকেও আমার গল্পের খবর জানালাম। একজন যেহেতু জানলেন বাকী সবাই জানতে অসুবিধা কোথায়? উনাকে আমার ব্লগের গল্পগুলো দেখালাম। উনি তৎক্ষনাৎ সবগুলো লেখায় চোখ বোলাতে শুরু করলেন। 'আপনি লিখেছেন এসব?' - ভয়াবহ সন্দেহ তার চোখে মুখে!
ব্লগোস্ফিয়ারে আমার পুর্ব পরিচিত কেউ নেই। এতিম অসহায়ের মত ব্লগিং করি আমি। আমি যেমন কাউকে চিনি না তেমনি কোন ব্লগারও সম্ভবতঃ আমার পরিচয় জানেন না। তাই ভাবছি আমার অফিস থেকেই 'আমি গল্পকার' এর প্রচার কাজ শুরু করব! (নিজেকে 'লেখক' ভাবতে ইচ্ছে করছে ইদানীং!) অফিসে আমার প্রায় ৪০ জন ইন্টারনেট ইউজার কলিগ! এদেও মধ্যে কেউ কেউ ব্লগার হয়ে গেলে আমার দলও ভারী হবে নিশ্চয়ই! তবে সবাইকে ব্লগিঙএর খবর দিয়ে দিলে কি হতে পারে তা নিয়ে একটু চিন্তিত আমি! অফিস ফাকি দিয়ে সবাই কি ব্লগিং করা বা গল্প পড়ায় মত্ত হবেন? এরকম হলে তো অফিসে কাজের বারোটা বাজবে! আর তাছাড়া সবাইতো আর আমার শুভানুধ্যায়ী নন। বরং উল্টোটা হবার সম্ভাবনাই বেশী (আমার অসামাজিক আচরনের কারনে!)। উপরন্তু খাদ্য ও খাদক শিরোনামের লেখাটা পড়ে দু একজন যে ভীষন রেগে যাবেন এতে কোন সন্দেহ নেই!
তো, যে প্রসঙ্গে এই ফালতু প্রলাপ তা হচ্ছে - কলিগ 'মামা' গল্পটি পড়ার পর আমাকে সেটা আরো বড় করার জন্য আইডিয়া দিয়েছেন! সেদিনই তিনি আমাকে বেশ উৎসাহ নিয়ে তার আইডিয়া জানালেন! তার চোখে মুখে নব্য আবিষ্কারের ছাপ!
তার আইডিয়া আমার কাছে ভালই মনে হয়েছে। আমি তার আইডিয়া অনুযায়ী মামা গল্পের দ্বিতীয় পর্ব লিখে ফেললাম।

দুর্ঘটনা

গতকাল একটা দুর্ঘটনা ঘটে গেল। অতি দরকারী একটা জিনিস হারালাম আমি। জিনিসটা হারানোর পর মনে হল ইস যদি এটা না করে ওটা করতাম তাহলে নিশ্চয়ই জিনিসটা হারাতে হতো না। আমাদের জীবন টুকরো টুকরো ঘটনার সমষ্টি। টুকরো ঘটনাগুলোও একবার করেই ঘটে যায়। যেগুলো আমরা পাল্টানোর বা নতুন করে ঘটানোর সুযোগ পাই না। একবার ঘটে গেলে তা জীবন ইতিহাসের পাতায় ঠাই করে নেয়। তারপরও ভাবি ইস যদি এটা না করে ওটা করতাম তবে ঘটনাটা ঘটতো না। কিন্তু এটা না করে ওটা করলে যে কি ঘটত তা সাধারনতঃ আমরা চিন্তা করিনা। আমি অবশ্য বিষয়টা নিয়ে বেশী চিন্তা করতে গিয়েই এই লেখাটা লিখে ফেললাম। জিনিসটা না হারালে নিশ্চয়ই এ লেখাটার জন্ম হতো না!
প্রতিদিনের মত গতকালও দুপুরে বাসায় গিয়েছিলাম। আধাকিলোমিটারের মত দুরত্ব হবে বোধহয়। (বেশীও হতে পারে)। বাসা টু অফিস যাতায়াতে আমি সব পন্থাই ব্যাবহার করি। কখনো হেটে, কখনো রিক্সায়, আবার কখনো বাসে। সবটারই কিছু সুবিধা অসুবিধা রয়েছে। রিক্সাকে বেশ ঘুরপথে আসতে হয়। বাসে এলে দুটো স্পটের এক স্পটে নামলেই চলে। প্রথম স্পটে নামলে অফিসটা দ্বিতীয় স্পটের তুলনায় সামান্য দুর হয়। কিন্তু দ্বিতীয় স্পটে নামতে গেলে প্রথম স্পটের ট্রাফিক সিগনাল পার হতে বেশ সময় লাগে। যাই হোক, বাসা থেকে ফেরার পথে দুর্ঘটনাটা ঘটল; এ প্রসঙ্গে বিশেষ কারনে চার রকম দুর্ঘটনার বিবরন দেয়া হল:
(১) বাসা থেকে বের হয়ে মুল রাস্তার মোড়ে দাড়ালাম। বেশ রোদ উঠেছে - হাটতে ইচ্ছে করছে না। বেশ কয়েকটা গাড়ি থামল কিন্তু প্রচন্ড ভীড় তাতে। লোকজন ঠেলাঠেলি করে উঠছে। আমি দাড়িয়ে রইলাম। একটু পরেই বড় একটা বাস আসল। বাসের পাদানী দুটো ফাকা। আমি পাদানীতে উঠে দাড়ালাম। চশমাটা খুলে সার্টের পকেটে রাখলাম। পকেট থেকে মানিব্যাগ বের করে বাস ভাড়া দিলাম। অল্পক্ষনের মধ্যেই বাসটি প্রথম স্পটের ট্রাফিক সিগনালে আটকা পড়ল। নেমে যাব কি? ঠেলাঠেলি করে লোকজন নামছে। এই ব্যাপারটি আমার খুব বিরক্ত লাগে। দাঁতে দাঁত চেঁপে দাড়িয়ে রইলাম। বেশ রোদ। সামনে গিয়েই নামি। কপাল ভাল তক্ষুনি সবুজ বাতি জলে উঠল। গাড়িটি চলতে লাগল। কয়েকমুহুর্তের মধ্যেই চলে এল আমার গন্তব্যে। ধীরে সুস্থে নামছিলাম। পেছন থেকে ঠেলে ঠুলে দ্রুত একলোক নেমে গেল। লোকটির ধাক্কায় আমিও দ্রুত নেমে গেলাম। নামার সময় মনে হল কিছু একটা পড়ে গেল আমার। নেমে পকেটে হাত দিয়ে দেখি আমার চশমা নেই। কি করব বুঝতে পারছিলাম না। বাসটি চলে যাচ্ছে। হঠাৎ ’ফট’ করে একটা শব্দ হল শুনলাম। গাড়িটা চলে যেতেই দেখি আমার চশমাটা গাড়ীর পেছনের চাকার নিচে পড়ে চ্যাপ্টা হয়ে গেছে। আমি অল্পক্ষন দাড়িয়ে দেখলাম। তারপর দীর্ঘশ্বাস ফেলে চলে এলাম। আগের স্পটে নামলেই বোধহয় ভাল হত। ভাবলাম আমি। চশমাটা হারাতে হত না।
(২) বাসা থেকে বের হয়ে মুল রাস্তার মোড়ে দাড়ালাম। বেশ রোদ উঠেছে - হাটতে ইচ্ছে করছে না। বেশ কয়েকটা গাড়ি থামল কিন্তু প্রচন্ড ভীড় তাতে। লোকজন ঠেলাঠেলি করে উঠছে। আমি দাড়িয়ে রইলাম। একটু পরেই বড় একটা বাস আসল। বাসের পাদানী দুটো ফাকা। আমি উঠে পড়লাম। চশমাটা খুলে সার্টের পকেটে রাখলাম। পকেট থেকে মানিব্যাগ বের করে বাস ভাড়া দিলাম। অল্পক্ষনের মধ্যেই বাসটি প্রথম স্পটের ট্রাফিক সিগনালে আটকা পড়ল। নেমে যাব কি? ঠেলাঠেলি করে লোকজন নামছে। এই ব্যাপারটি আমার খুব বিরক্ত লাগে। দাঁতে দাঁত চেপে দাড়িয়ে রইলাম। বেশ রোদ। সামনে গিয়েই নামি। কিন্তু পেছন থেকে একলোক ঠেলে ঠুলে দ্রুত নামার চেষ্টা করছে। ততক্ষনে আবার সবুজ বাতি জলে উঠেছে। গাড়িটি আস্তে আস্তে চলতে শুরু করেছে। এদিকে লোকটির ঠেলাঠেলি সামলাতে না পেরে মোটামুটি ছিটকে নিচে নেমে এলাম। নেমে দাড়িয়ে পকেটে হাত দিয়ে দেখি আমার মানিব্যাগ নেই। কি করব বুঝতে পারছিলাম না। বাসটি চলে গেল। আমি অল্পক্ষন দাড়ালাম। আশেপাশে মানিব্যাগটি খুজলাম কিন্তু চোখে পড়ল না। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে অফিসে চলে এলাম। হেটে চলে আসলেই বোধহয় ভাল হত - ভাবলাম আমি। মানিব্যাগটা হারাতে হত না। কিছু টাকা; এটিএম কার্ডগুলো; মেডিকেল কার্ড; আইডি কার্ড সব গেল। আবার নতুন করে আবার করতে হবে সব।
(৩) বাসা থেকে বের হয়ে মুল রাস্তার মোড়ে দাড়ালাম। বেশ রোদ উঠেছে - হাটতে ইচ্ছে করছে না। বেশ কয়েকটা গাড়ি থামল কিন্তু প্রচন্ড ভীড় তাতে। লোকজন ঠেলাঠেলি করে উঠছে। আমি দাড়িয়ে রইলাম। একটু পরেই বড় একটা বাস আসল। বাসের পাদানীতেও মানুষ ঝুলছে। কোথাও একটা রিক্সাও নেই। ধেৎ হেটেই যাব। পকেট থেকে চশমাটা বের করলাম; রোদ কাটানোর জন্য। চশমার সাথে আটকে আমার পেনড্রাইভটা রাস্তায় পড়ে গেল। পেনড্রাইভটা আমি সবসময় সার্টের পকেটে রাখি - ঘামে বা চাপে নষ্ট হয়ে যাবার ভয়ে। নীচু হয়ে তুলে প্যান্টের পকেটে রাখলাম। তারপর হাটতে লাগলাম। হঠাৎই মেঘের আড়ালে চলে গেল রোদ। যাক হেটে এসে ভালই করেছি। ধীরে সুস্থে অফিসে চলে এলাম। পেন ড্রাইভ বের করার জন্য পকেটে হাত দিয়ে ওটা খুজে পেলাম না। সবগুলো পকেটই তন্ন তন্ন করে খুজলাম। পেলাম না। এমনকি সার্টের পকেটটাও দেখলাম। যদিও ওখানে থাকার কোন সম্ভাবনাই নেই। শেষে প্যন্টের পকেট উল্টে দেখি একটা ফুটো। পেন ড্রাইভ পড়ে যাবার জন্য বেশ বড়ই বলা যায়। খুব সম্ভবতঃ চাবির গোছার চাপে ফুটোটার সৃষ্টি হয়েছে। ধেৎ! কেন যে ওটা পকেট বদল করেছিলাম! রিক্সা বা বাসে এলে হয়তো বদলানোর দরকার হতো না আর এ ঘটনাটাও ঘটতো না। আমার অনেক দরকারী ফাইল ছিল ওটার মধ্যে যার কোন ব্যাকআপও কোথাও রাখিনি!
(৪) বাসা থেকে বের হয়ে মুল রাস্তার মোড়ে দাড়ালাম। বেশ রোদ উঠেছে - হাটতে ইচ্ছে করছে না। বেশ কয়েকটা গাড়ি থামল কিন্তু প্রচন্ড ভীড় তাতে। লোকজন ঠেলাঠেলি করে উঠছে। আমি দাড়িয়ে রইলাম। একটু পরেই বড় একটা বাস আসল। কিন্তু বাসের পাদানীতেও মানুষ ঝুলছে। আমি একটা রিক্সা নিয়ে নিলাম। একটু দেরী হবে কিন্তু কিছু করার নেই। যেতে যেতে হঠাৎ সেল ফোনটা বেজে উঠল। আমি পকেট থেকে ফোনটা বের করে কথা শুরু করলাম। হঠাৎ করেই সামনের দিক থেকে আগত রিক্সার চাকার সাথে আমার রিক্সার চাকা আটকে গিয়ে প্রচন্ড শব্দে থেমে গেল রিক্সা। আমিও পড়তে পড়তে কোনমতে নিজেকে সামলালাম। ঘটনার আকষ্মিকতায় হাত থেকে উড়ে সামনে রাস্তায় গিয়ে পড়ে দুভাগ হয়ে গেল আমার সেল ফোন। দুর্ভাগ্য আর কাকে বলে। একটা পিকআপ আসছিল ওপাশ থেকে। ওটার চাকার নীচে পড়ে মটমট করে ভেঙ্গে গেল ফোনটা। গিয়ে ফোনের ধংসাবশেষ কুড়িয়ে নিয়ে এলাম। স্ক্রিনটা ভেঙ্গে আলাদা হয়ে গিয়েছে। কেন যে রিক্সা নিতে গেলাম! রাস্তায় আর একটু অপেক্ষা করলেই তো গাড়ি পেতাম। অথবা হেটেও যেতে পারতাম। গাড়ীতে বা হেটে গেলে নিশ্চয়ই আজ আমার ফোনটা হারাতে হত না।
যাই হোক এই হল ঘটনা। যার মধ্যে একটি সত্য। যেটা ঘটে গেছে। ফেরানোর উপায় নেই। বাকি তিনটা বানানো। আন্দাজ করতে পারেন কোন ঘটনাটা ঘটেছে সত্যিকারে?

ছায়া (পর্ব-১,২)

(জনাব মৃদুল আহমেদ কে উৎসর্গ করা হল। উনার দেয়া প্লটের ’ছায়া’ অবলম্বনে লিখলাম। ভুতের গল্প লেখার কথা ছিল; হচ্ছে কিনা জানিনা)
'স্যার, অনেক্ষন যাবৎ আপনার জন্য অপেক্ষা করছি। '- রুমে ঢুকতেই লোকটাকে দেখতে পান মৃদুল আহমেদ; ঘরের ঠিক মাঝে দাড়িয়ে আছে। জানালা দিয়ে শেষ বিকেলের রোদ এসে পড়েছে ঘরে। জানালা বরাবর দাড়িয়ে থাকা লোকটির ছায়া পড়েছে দ্বিগুন হয়ে। একাগ্রচিত্তে নিজের ছায়ার দিকে তাকিয়ে আছে সে।
'মোতালেব' - মৃদুল আহমেদ চিৎকার করে ডাকলেন। লোকটির মেকি আচরন গায়ে মাখলেন না। অনেকেই অদ্ভুত আচরন করে তার সাথে। বোঝাতে চায় তারা ব্যাতিক্রমী কিছু। কোন রকম সম্ভাষন বিহীনভাবে তার সাথে কথা শুরু করা এই লোকটিকেও সেই গোত্রের মনে হচ্ছে।
মোতালেব উকি দিল দরজায়। ইশারায় তাকে পর্দা টেনে দিতে বলেন মৃদুল আহমেদ। শেষ বিকেলের রোদ তার প্রিয় হলেও আজকের রোদ তার ভাল লাগছে না। আজ সারাটা দিন মাটি হয়েছে। গতপরশু ধানমন্ডীতে তার পরিচিত একজন ব্যবসায়ী হার্টএটাক করে মারা গেছেন। খুবই সাধারন একটা কেস। তদন্ত করে ডাক্তারী রিপোর্ট মোতাবেক তাই প্রমানিত হয়েছে। কিন্তু সমস্যা বাধিয়েছে সেই ছায়া। বাড়ির মালকিনের বক্তব্য সে ছায়াটাকে তার স্বামীর ঘরে যেতে দেখেছে। স্বামীর চিৎকার শুনে ঘরে গিয়ে দেখে স্বামী তার মরে পরে আছে। বাড়ির দারোয়ানও একই কথা বলেছে। সে নাকি ছায়াটাকে বাড়ির সদর দরজা দিয়ে ঢুকতে দেখেছে। সে এতই ভয় পেয়েছে যে সে চাকরীর মায়া ত্যাগ করে সে বাড়ি ছেড়ে ভেগেও গেছে।
সেদিন বাড়ির মালকিনের মরা কান্নার জন্য তার সঙ্গে এ ব্যাপরে কোন কথা বলেননি তিনি। আজ গিয়ে সারাটাদিন তাকে বোঝাতে গলদঘর্ম হয়েছেন। তাকে কোনভাবেই বোঝানো যায়নি যে তার স্বামীর স্বাভাবিক মৃত্যু ঘটেছে।
বেশ কিছুদিন যাবৎ এই ছায়ার উৎপাত শুরু হয়েছে ঢাকা শহরের কয়েকটি এলাকায়। এতদিন ছায়া দেখা, ভয় পাওয়া, চিৎকার চেঁচামেচী - এর মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল ঘটনা। কিন্তু ছায়াকে জড়িয়ে এই মৃত্যুর ঘটনায় মানুষের ভীতি আরও বেড়ে গিয়েছে।
এদিকে এটা নিয়ে পত্রিকাওলারাও বাড়াবাড়ি শুরু করেছে। বিশাল হেডিং দিয়ে নিউজ করেছে। 'ঢাকা শহরে এবার ছায়ার প্রথম শিকার'। 'ছায়ার আক্রমনে ব্যবসায়ীর মৃত্যু'। ইত্যাদি ইত্যাদি। আরে বাবা প্যানিক ছড়ানোর দরকারটা কি?
ফলাফল যা হবার তাই হয়েছে। কমবেশী সবাই এখন ছায়া দেখা শুরু করেছে। মৃদুল আহমেদের ধারনা এসবই তাদের অবচেতন মনের ভুল। যেমন সেদিন কে একজন রাতের বেলা তার নিজের ঘরে ঝোলানো কাপড় দেখে ছায়া ছায়া করে মুর্ছা গেছে। এই হচ্ছে অবস্থা।
মৃদুল আহমেদের সন্দেহ কিছু লোক এই সুযোগে প্রতারনা করার চেষ্টা করছে। মিরপুরে গতরাতে এক বাড়িতে ডাকাতি হয়েছে। সেখানেও নাকি লোকজন শুধু ছায়া দেখতে পেয়েছে। বাড়ির সিকিউরিটির লোক নাকি কয়েকটা ছায়া ঢুকতে দেখেছে। খুব সম্ভবতঃ কালো পোষাক পরে ঢুকেছিল দুর্বৃত্ত। ছায়ার ভয়েই লোকজন কিছু করার সাহস করেনি। নির্বিঘ্নে ডাকাতি সেরে গেছে ডাকাতেরা।
সবগুলো বিচ্ছিন্ন ঘটনা হলেও প্রতারক চক্রের পোয়াবারো হয়েছে।
'স্যার, অনেক্ষন যাবৎ আপনার জন্য অপেক্ষা করছি।' -লোকটি আবার বলে ওঠে। এবার অবশ্য ঘরের মাঝখানে নয়। তার ডেস্কের সামনের চেয়ারে বসে আছে সে।
'ওহ গড', লোকটিকে যে বসিয়ে রেখেছে তা মনেই নেই। ছায়ার ভাবনায় ডুবে গিয়ে লোকটির কথা ভুলেই গিয়েছিলেন তিনি। লোকটিকে বসিয়ে রাখার জন্য এখন একটু খারাপই লাগছে।-'আমি খুবই দুঃখিত; আপনাকে এতক্ষন বসিয়ে রাখার জন্য।' -একটু ভাল করে দেখলেন তিনি লোকটিকে। মাঝ বয়েসি লোক। চোখের নীচে কালশিটে দাগ। চেহারা দেখেই বোঝা যায় প্রচুর টেনশন করেন সবকিছুতেই। -'বলুন আপনার জন্য কি করতে পারি আমি।'
'আমি একটা সমস্যায় পড়েছি।'- ইতস্ততঃ করতে থাকে লোকটি।'হ্যা বলুন। আমার কাছে তো সমস্যা নিয়েই আসবেন। বলুন নিঃসংকোচে বলুন।''মানে আমি আমার ছায়া নিয়ে বেশ ঝামেলায় পড়ে গেছি।'এই কথা- মনে মনে একটু নিরাশ হন মৃদুল আহমেদ। ছায়া ছাড়া কি আর কোন কিছু দেখতে পাচ্ছে না নাকি লোকজন?'ও আচ্ছা। তাহলে আপনিও ছায়া দেখতে শুরু করেছেন। আপনি কোথায় থাকেন আর কিভাবে ছায়া দেখলেন ডিটেইলস বলুনতো?''না মানে- আমি আসলে ছায়া দেখে ভয় পাচ্ছি না।'- একটু থামে লোকটি। -'শ্যামলীতে আমার বাসা।''আর' - আবারো ইতস্তত করে লোকটি।- 'আপনি তো পত্রিকায় ছায়া দেখে ভয় পেয়ে মৃত্যুর খবরটি দেখেছেন তাইনা?''ব্যবসায়ী আকবর সাহেবের মৃত্যুর খবর?'-এইবার একটু আগ্রহী হন মৃদুল আহমেদ।- 'আপনি কি আকবর সাহেবের কেউ হন?''না আমি উনার কেউ না। আমি আসলে তাকে কোনদিন দেখিওনি চিনিওনা।''তাহলে?''আসলে- কিভাবে যে বলি। এতদিন বিষয়টা নিজেই সমাধানের চেষ্টা করছিলাম তাই কাউকে কিছু বলিনি। কিন্তু আকবর সাহেবের মৃত্যুর ঘটনার পর থেকে আমি অনুশোচনায় দগ্ধ হচ্ছি। আর আপনার সাথে আগেই দেখা করতে চেয়েছিলাম। কিন্তু পারিনি। ' - এক নিশ্বাসে কথাগুলো বলে ফেলে লোকটি।
'দেখুন এভাবে বললে তো আমি কিছু বুঝতে পারছি না। অযথা হেয়ালী না করে যা বলতে চান সরাসরি বলুন। আপনি কি আকবর সাহেবের মৃত্যুর সাথে জড়িত?''ঠিক তা নয়। তবে আকবর সাহেবের স্ত্রী এবং বাড়ির দারোয়ান যেকথা বলেছে তা সঠিক।''তার মানে?''মানে যে ছায়াটা ওরা দেখেছে ওটা সত্যিই একটা ছায়া।''ও'- চেয়ারে হেলান দিয়ে বসেন মৃদুল আহমেদ। তার আগ্রহ কমে যাচ্ছে। ছায়া দেখা যাচ্ছে লোকজনের মানসিক সমস্যারও সৃষ্টি করছে।'তারমানে আপনি বলতে চান ঢাকা শহরে যে ছায়ার উৎপাত শুরু হয়েছে সেগুলো সত্যিই ছায়া?''জি- আসলে তাই। ছায়াটা সত্যিই একটা মানুষের ছায়া।''তাহলে গতকাল যে ডাকাতিটা হল ওখানে অতগুলো ছায়া এল কিকরে?''সেটা অবশ্য আমি জানি না। ঐ ছায়াগুলোর ব্যাপারে সত্যিই আমি কিছু জানি না। ''তারমানে অন্ততঃ একটা ছায়ার ব্যাপারে আপনি জানেন বলতে চাচ্ছেন?''জি ঠিক তাই।''আপনি ছায়াটাকে চেনেন মনে হচেছ?''জি - ছায়াটাকে আমি চিনি।''তা আপনার এমন মনে হবার কারন?''কারন যে ছায়াটা নিয়ে এত হুলুস্থুল শুরু হয়েছে' - চোখ তুলে সরাসরি তাকাল সে মৃদুল আহমেদের দিকে - 'সে ছায়াটা আমার।'

***********

একটু চিন্তিত দেখাল আহমেদ সাহেবকে। লোকটিকে গুরুত্ব দিতেই হচ্ছে। ছায়ার সাথে তার সরাসরি সংশ্লিষ্টতা থাক বা না থাক; ব্যপারটা যে তাকে কোনভাবে ভোগাচ্ছে এতে কোন সন্দেহ নেই। লোকটির কথাবার্তায় তাই মনে হচ্ছে। আর কোন কারন ছাড়া লোকটি এতক্ষন বসে থাকতো না নিশ্চয়ই।
'আপনার বিশ্বাস হচ্ছে না তো? না হবারই কথা' - আহমেদ সাহেবের নীরবতা দেখে লোকটি আবার বলতে শুরু করে। -'প্রথম প্রথম আমিও ব্যাপারটা বিশ্বাস করতে পারতাম না - ভাবতাম আমি স্বপ্ন দেখছি অথবা সবই আমার মনের কল্পনা। কিন্তু আস্তে আস্তে সব বুঝতে পারলাম। ব্যপারটা আসলেই সত্যি - স্বপ্ন বা কল্পনা নয়। যেমন শেষ ঘটনাটাই বলি। আকবর সাহেবের বাসার ভিতর -'
ডান হাত ট্রাফিক পুলিশের মত উচু করে তুললেন আহমেদ সাহেব; লোকটিকে থামানোর জন্য। - 'থামুন মিস্টার..' -লোকটির নাম বলতে গিয়ে বুঝলেন সামনে বসা লোকটির নামটাই এখনো জানা হয়নি। সাধারনতঃ এরকম হয়না তার।'এই দেখুন আপনার নামটাই এখনো জানা হয়নি।''আমার নাম বোরহান। মোঃ বোরহান উদ্দিন।''বোরহান উদ্দিন।' - নীচুস্বরে একবার নামটা আওড়ালেন আহমেদ সাহেব। তারপর লোকটির দিকে তাকালেন। -'দেখুন, মিস্টার বোরহান - আপনি এভাবে বললে থাকলে আমি কিছুই বুঝতে পারব না। বরং বিষযটা আরো গোলমেলে লাগবে আমার কাছে। আমি আপনার কথা বিশ্বাস করছি। বুঝতে পারছি ঐ ছায়াটা আপনাই ছায়া। কিন্তু এ ব্যাপারে আপনাকে সাহায্য করতে আমাকে সবকিছু শুরু থেকে জানাতে হবে। সেকারনে আমি আপনাকে যা যা জিজ্ঞেস করব তার ঠিক ঠিক উত্তর দেবেন আশা করি।'
বোরহান নামের লোকটি সম্মতিসূচক মাথা নাড়াল।
'আপনি কি কাজ করেন?'
'একটা এন.জি.ও তে চাকুরী করি - নাম বন্ধু। শ্যমলীতেই আমার অফিস। বাসা থেকে মাত্র কয়েক মিনিটের পথ।' - লোকটির উত্তেজিত ভঙ্গি দেখে মনে হল আকবর সাহেবের ঘটনা না বলা পর্যন্ত স্বস্তি পাচ্ছে না সে।
'আপনার চেহারা দেখে মনে হচ্ছে আপনি অনেক রাত পর্যন্ত জেগে থাকেন। সত্যিই কি?'
'হ্যা ঠিক, আসলে গল্পের বই পড়ার নেশা রয়েছে আমার। অনেক রাত জেগে গল্পের বই পড়ে থাকি। ঘুমাতে ঘুমাতে রাত একটা দুটো বেজে যায়।'
'কি ধরনের বই আপনি সাধারনত পড়ে থাকেন?'
'সব ধরনের বইই পড়ি। তবে থ্রিলার, রহস্যোপন্যাস এগুলো আমার পছন্দের। ও হ্যা হরর বইও পড়ি মাঝে মাঝে। তবে যেদিন হরর বই পড়ি সেদিন রাতে ঘুমাতে পারি না। ভোরের দিকে যখন ফযরের আজান হয় তখন কিছুটা সাহস ফিরে আসে। তখনই ঘুমিয়ে পড়ি। '
'বাড়িতে আপনি একা তাইনা?'
'কি ভাবে বুঝলেন?'
'এমনি অনুমান করলাম। সংসারী মানুষ কখনো রাত জেগে গল্প পড়ার সময় পাবার কথা নয়।'
'তা ঠিক। একা বাসায় থাকি। সময় কাটতে চায় না। তাছাড়া ঘুমও সহজে আসে না তাই.. - ও হ্যা, ইদানীং রাতে পত্রিকাও পড়ি। ছায়া সংক্রান্ত ঘটনা কি ছাপা হল তা পড়ি খুটিয়ে খুটিয়ে।'
'ও আচ্ছা। তা, এই বাসায় আপনি কতদিন যাবৎ আছেন?'
'তা প্রায় চার বছর হয়ে গেছে। বিয়ের পর থেকেই এই বাসায় আমার বসবাস।'
'বিয়ের পর থেকে?' - একটু অবাক হলেন আহমেদ সাহেব। তিনি লোকটিকে অবিবাহিত মেসের বাসিন্দা ভেবেছিলেন।'আপনার স্ত্রীকোথায়?'
লোকটিও মনে হল একটু থতমত খেয়ে গেছে। বিয়ের ব্যপারটা প্রকাশ হয়ে যাওয়াতে। বেশ কয়েক মুহুর্ত নীরব থেকে উত্তর দিল বোরহান -'সে চলে গেছে।'
'চলে গেছে মানে?'
'মানে ওর সাথে আমার সম্পর্ক নাই। প্রায় বছরখানেক হল ওর সাথে আমার ছাড়াছাড়ি হয়ে গেছে। ছাড়াছাড়িটা অবশ্য ওই করিয়েছে। তারপর থেকে আমি বাসায় একাই থাকি।'
'আচ্ছা স্যরি। আর ব্যক্তিগত বিষয়ে জিজ্ঞেস করার জন্য দুখিত। তবে বুঝেনইতো, আপনার ছায়া সমস্যা সমাধানের জন্য আমার সবকিছুই জানা দরকার। '
'না, না, কোন অসুবিধা নেই।' - লোকটি প্রবল বেগে মাথা নাড়াতে থাকল। আমি অবশ্যই সবকিছু বলব আপনাকে।
'আচ্ছা - আপনিতো জানেনই, ঢাকা শহরে যে ছায়া বা ছায়াগুলোর উতপাত শুরু হয়েছে সেগুলো শুধু রাতের বেলায়ই বের হয়। এ ব্যাপারে আপনি কি বলেন। আপনার ছায়াও কি শুধু রাতের বেলা বের হয়?' - আহমেদ সাহেব প্রশ্ন করেন।
'ঠিক তাই। আমি রাতে ঘুমিয়ে যাবার পরই ছায়াটা আমার থেকে আলাদা হয়ে যায়; আর আমার আত্মাও একই সাথে আলাদা হয়ে ঐ ছায়ার ভেতর ঢুকে যায়। ছায়াটাই হয়ে যাই আমি। '
'দিনের বেলায় কখনো এরকম হয়নি?'
'না, দিনের বেলায় কখনো এ ঘটনা ঘটেনি। এমনকি দিনে ঘুমালেও এটা ঘটে না। '
'যাই হোক, আপনি বলতে চাচ্ছেন আপনার নিজস্ব স্বত্ত্বাও আপনার ছায়ার সাথে চলাফেরা করে এবং তা শুধু রাতের বেলায় - এইতো?'
'স্বত্ত্বা বলতে আমার আত্মাকে বোঝাচ্ছেন তো?' - আহমেদ সাহেব মাথা নেড়ে সায় দিলেন লোকটির প্রশ্নে।
সম্মতি পেয়ে আবার শুরু করল বোরহান -'হ্যা, আমি তাই মনে করি; আমার আত্মাও আমার ছায়ার সাথে চলাফেরা করে। আসলে আমার সাথে ঐ ছায়ার কোন পার্থক্য নেই। দিনের বেলা যেমন আমি মানুষ। রাতের বেলা আমি ছায়া-মানুষ। পার্থক্য এটুকুই - দিনে আমি রক্তমাংশের মানুষ আর রাতে ছায়া। তবে যেহেতু ওটা শুধুই আমার ছায়া তাই ছায়ামানব হিসাবে শারীরিক কোন ক্ষমতা আমার থাকেনা। আমার ইচ্ছা শক্তির উপর নির্ভর করে ওটার নড়াচড়া, চলাফেরা। যেমন সেদিন - বলতে গিয়েও আহমেদ সাহেবের দিকে তাকিয়ে থেমে গেল বোরহান। '
মুচকি হাসলেন আহমেদ সাহেব। লোকটি ঘটনাটা না বলা পর্যন্ত তার উত্তেজনা কমবে না মনে হচ্ছে। - 'ঠিক আছে আপনি বলে যান।'
'আসলে ঘটনাটা না বললে আমি স্বস্তি পাচ্ছি না। আকবর সাহেবের মৃত্যুতে আমার বিন্দুমাত্র দোষ নেই মনে করি। আমি শুধু তাকে ভয় দেখাতে চেয়েছিলাম। কিন্তু উনি যে মরে যাবেন তা ভাবিনি। আপনাকে তো আগেই বলেছি। উনি মারা যাবার পর আমার অনুশোচনা হচ্ছে। তাই এখন আর এই ছায়া ছায়া খেলা খেলতে ইচ্ছে করছে না। কিন্তু আমি বন্ধও করতে পারছি না। তাই আপনার সাহায্য চাইছি।'
'না ঠিক আছে। আমি এমনিতেও ঘটনাটা আপনার মুখ থেকে শুনতাম একটু পরে। আপনি সংক্ষেপে বলে ফেলুন।'
'ঠিক আছে আমি সংক্ষেপেই বলি। আমি আকবর সাহেবের বেডরুমের দরজার নিচ দিয়ে ঢুকে পড়ি। ভেতরে স্বামী স্ত্রী দুজন বিছানায় বসে টিভি দেখছিল। আমি ঢুকেছি তারা বুঝেননি। তারা একমনে টিভির দিকে তাকিয়েছিল আর' - একটু থামল বোরহান।
'আর ? আর কি?' - আহমেদ সাহেবের মনে হল কিছু একটা লুকানোর চেষ্টা করছে লোকটি।
'মানে সেজন্যই ওরা আমাকে দেখতে পেল না। শেষে আমি ওদের সামনে গেলাম। ওদের টিভির ডানদিকের দেয়ালে ওরা আমাকে দেখতে পেল। আমি দু হাত উচু করে ভয় দেখানোর ভাব করলাম। আকবর সাহেব - ওটা কি? ওটা কি? - বলে চিৎকার দিয়ে বিছান থেকে লাফিয়ে উঠে দাড়ালেন। কিসের ছায়া সেটা পরীক্ষা করার জন্য দুবার পেছনে তাকালেন। কিছু না দেখে চিৎকার দিয়ে বুকে হাত দিয়ে বসে পড়লেন। তার স্ত্রীও একই ভাবে আমাকে দেখে দেখে বিকট চিৎকার দিলেন। আমি দ্রুত বের হয়ে চলে এলাম। '
'বের হয়ে চলে এলেন?'
'হ্যা তাই। এবার আপনিই বলুন আমার কি দোষ এর মধ্যে?'
'না, ঠিক আছে। আমি আপনার কোন দোষ দেখছি না এর মধ্যে। কিন্তু এত লোক থাকতে আপনি কেন আকবর সাহেবের ঘরে গেলেন? আপনি থাকেন শ্যামলীতে। কাউকে ভয় দেখাতে শ্যামলী থেকে ধানমন্ডী পর্যন্ত যেতে হল কেন আপনাকে? আশেপাশের যে কোন বাড়িতে গেলেই তো হত - তাইনা?'
'আসলে' - একটু ইতস্ততঃ করল বোরহান। -'সত্যি কথা হচ্ছে আকবর সাহেবের সাথে আমার পরিচয় হয়েছিল। আমার এক দুঃসম্পর্কের আত্মীয়ের মাধ্যমে তার বাসায় গিয়েছিলাম। চাকুরী সংক্রান্ত ব্যপারে। মৌখিক পরীক্ষার আগেরদিন। তিনিও প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন যে আমাকে চাকুরীটা দেবেন। অথচ চাকুরীটা আমার হয়নি; একটা মেয়েকে দেয়া হয় চাকুরীটা। যেদিন এ খবরটা জানতে পারি সেদিনই মনে মনে ঠিক করি তাকে ভয় দেখাব। কিন্তু ভয় দেখানোতে যে উনি মারা যাবেন তা ঘুনাক্ষরেও চিন্তা করিনি।'
'তাই নাকি? কিছুক্ষন আগেও আপনি বলছিলেন আপনি তাকে কোনদিন দেখেননি আর চিনেনও না। '
'আসলে আমি ভয় পেয়েছিলাম। যদি আকবর সাহেবের মৃত্যুর জন্য আমাকে দায়ি করা হয়। কিন্তু সেটা তো সম্ভব নয় তাই না। আমি তো আর নিজে ভয় দেখিয়ে তাকে মেরে ফেলিনি। ভয় দেখিয়েছে আমার ছায়া। দোষী সাব্যস্ত হলে আমার ছায়াই হবে তাইনা। '
'দেখুন আপনার ভয় পাওয়ার কোন কারন নেই। ' - আহমেদ সাহেব আশ্বস্ত করেন বোরহানকে। -'আপনাকে তো বলেছিই; এতে আপনার কোন দোষ নেই। এ পর্যন্ত এই পৃথিবীতে অপরাধের জন্য কোন ছায়াকে শাস্তি দেয়া হয়নি। কোনরকম শাস্তিও বিধানও তৈরী হয়নি। অতএব আপনি নিশ্চিত থাকুন। এবং কোনকিছু না লুকিয়ে সবকিছু খুলে বলুন। এতে সমস্যাটার দ্রুত সমাধান হয়ে যাবে। '
'ঠিক আছে। আর কিছু লুকাব না। '
'আপনি কবে জানতে পারেন যে আপনার চাকুরী হয়নি?'
'এইতো গত সপ্তাহে। '
'তাহলে এতদিন তাকে ভয় দেখাননি কেন? আপনার তো উচিৎ ছিল সেদিনই রাতে তার বাড়ি গিয়ে হুমহাম করে ভয় দেখিয়ে আসা তাইনা?'
'বুঝছি আপনি আমার কথা বিশ্বাস করতে পারছেন না। যাই হোক, সেদিন রাতেই যাইনি কারন সেদিন আমার ছায়ামানবের কর্মকান্ড হয় নি। মানে - ছায়াটা সেদিন রাতে জেগে উঠেনি।'
'তারমানে আপনার ছায়া প্রতি রাতে জেগে উঠে না?'
'না' - ডানে বায়ে মাথা দোলায় বোরহান।
'কেন বলতে পারেন?'
'সেটা আমি জানিনা। সত্যিই জানিনা।'
আহমেদ সাহেব ঘড়ি দেখলেন। সন্ধ্যা হয়ে গেছে। -'আমরা আজ থামব এখানেই। আপনার ছায়ার ব্যাপারে কয়েকটা ব্যাপার পরিষ্কার হয়েছে আমার কাছে। আবার প্রশ্নও তৈরী হয়েছে কয়েকটি। সে ব্যাপারে পরে আলাপ করব ঠিক আছে?'
'তাহলে আমি কি আজ ?' - চেয়ার ছেড়ে উঠতে শুরু করে বোরহান।
আবার হাত তুলে থামালেন ওকে আহমেদ সাহেব; ইশারায় আবার বসালেন। -'আমি আজ রাতে একটা পরীক্ষা করতে চাই। যদি আপনার আপত্তি না থাকে। আমি আপনার ছায়াটার কর্মকান্ড দেখতে চাচ্ছি। আপনার কোন অসুবিধা না হলে আজ আপনি আমার সাথে থেকে যান।'
'তা কিকরে হয়। আপনার অসুবিধা হবে। '
'দেখুন অসুবিধাটা এখানে বড় ব্যাপার নয়। তাছাড়া বাড়িতে আমি ছাড়া কেউ নেই আজ। ছায়ার ব্যাপারটা সত্য ধরে নিলে তা প্রমান করাটাই যুক্তিযুক্ত হবে তাই না?'
'আপনি চাইলে থাকব। আমার কোন অসুবিধা হবে না। কিন্তু ছায়াটা বের না হলে কিন্তু আপনাকে নিরাশ হতে হবে।'
'তাতে অসুবিধা নেই। দেখি না কি হয় - আশা করতে দোষ কি? তবে আপনি কিন্তু ছায়া হয়ে আমাকে ভয় দেখাবেন না। শেষে ভযে আমি মরে গেলে কিন্তু বিরাট ঝামেলা হয়ে যাবে। '
আহমেদ সাহেব শব্দ করে হাসলেন। তিনি মোটামুটি নিশ্চিত ছায়ার ব্যাপারটি বোরহান নামক এই লোকটির মনের কল্পনা। ছায়ার নিজস্ব কোন সত্ত্বা থাকতে পারে না। ছায়া সংক্রান্ত ঘটনাগুলোর প্রতিটাই তার মনে গেথে যায়। যে কারনে সে ঘনটাগুলো নিয়ে ইচ্ছেমত স্বপ্ন দেখতে থাকে।
আকবর সাহেবের মৃত্যু নিয়ে দেয়া তার বক্তব্যও আকবর সাহেবের স্ত্রীর বক্তব্যের সাথে মেলে না। আকবর সাহেবের স্ত্রীর ভাষ্য অনুযায়ী সে লোকটিকে তার স্বামীর ঘরে যেতে দেখেছে। অথচ বোরহান বলছে সে দুজনকেই বিছানায় বসে টিভি দেখতে দেখেছে। এ থেকেই বোঝা যায় বোরহান ঘটনাটা নিজের মনে বানিয়েছে। এখন তার মাথা থেকে ছায়ার ভুত দুর করার জন্য তাকে বিশ্বাস করাতে হবে যে সেটি শুধুই তার তার মনের কল্পনা।
তবে একটা ব্যাপার হঠাৎ মনে পড়ে যায় তার - যেটা জিজ্ঞেস করতে গিয়েও করা হয়নি - ঐ ঘটনাটা বলার সময় কিছু একটা লুকিয়েছে বোরহান। ব্যাপারটা পরে জানতে হবে। তিনি আজ ক্লান্ত।
আহমেদ সাহেব গলা উঁচু করে মোতালেব কে ডাকলেন।

চরিত্র-সত্যায়ন

(বি.দ্র.: এটা আমার জীবনের প্রথম সাহিত্য! ১৯৯৮ সালে লিখেছিলাম!)
পরীক্ষা পাশের পরে চাকুরী খুজিতে গিয়া যে সমস্যাটি প্রধান হইয়া দাড়াইল তাহা হইল সত্যায়ন। অর্থ্যাত গত বিশ বছর অধ্যয়নের ফলস্বরূপ যে কখানা সনদপত্র অর্জন করিয়াছি উহাদের অনুলিপির সত্যায়ন। চাকুরীদাতার ভয়, পাছে কেহ নকল সনদপত্র দাখিল করে। তাই উহাদের সীলমোহর মারিয়া প্রথম শ্রেনীর কর্মকর্তা (দ্বিতীয় কিংবা তৃতীয় শ্রেনীর হইলে হইবেনা!) কর্তৃক সত্যায়ন করাইয়া চাকুরীদাতার সম্মুখে হাজির করাইলে তবেই উনাদের মনঃপূত হয়। ভাবখানা এমন যে উহাতে কোনরূপ ভেজাল হইতে পারে না। অথচ তাঁহারা কি জানেননা যে প্রথম শ্রেনীর কর্মকর্তার ডিগ্রী এখন দোকানে অর্ডার দিয়া বানানো হয় ? চাকুরী প্রার্থী বেকার যুবকেরাই এখন এক একজন প্রথম শ্রেনীর কর্মকর্তা ? কি অবাক হইলেন ? অবাক হইবার কিছুই নাই। ইহা বাংলাদেশ। এই দেশে সবই সম্ভব। কিভাবে উহা হয় তাহাই এখন বলিতেছি।
বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নকালে হান্নান নামে আমার একজন বন্ধু ছিল। সে র্ছিল দর্শন বিভাগের ছাত্র। বি,সি,এস, পরীক্ষার ফরম পূরণ করিয়া উহা দাখিল করিবার সময় আমি সত্যায়ন সমস্যায় পড়িলাম। আমার অর্জিত সকল সনদের অনুলিপি সত্যায়ন করিতে হইবে। ইহা ছাড়াও ইউনিয়ন পরিষদ কর্তৃক নাগরিকত্বের সনদপত্রসহ প্রথম শ্রেনীর কর্মকর্তার নিকট হইতে চারিত্রিক সনদপত্রও দাখিল করিতে হইবে। আবার সেই প্রথম শ্রেনীর কর্মকর্তা! হায়, ভাবিয়া দুঃখ হয় ২০ বছরের অর্জিত স্বভাব চরিত্রের মালিকানা নাকি প্রথম শ্রেনীর কর্মকর্তার হাতে। তা না হইলে কি আর নিজের চরিত্রের খবর বাবা-মা কিংবা শিক্ষকদিগের কাছ হইতে না নিয়া নিতে হইবে ‘অজানা অচেনা’ কোন প্রথম শ্রেনীর কর্মকর্তার নিকট হইতে? মনে পড়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির সময় যে সনদপত্র দুখানার মালিক হইয়াছিলাম উহাদের অনুলিপি সত্যায়ন করাইয়াছিলাম মহাবিদ্যালয়ের পরিচিত শিক্ষক দ্বারা। তবে আরও যে একখানা সনদপত্র চাওয়া হইয়াছিল তাহা হইল চারিত্রিক সনদপত্র। তাহাও আবার মহাবিদ্যালয়ের অধ্যক্ষের নিকট হইতে। ব্যাপারটা তখন আমার অর্ধপক্ক মস্তিস্ক মানিয়া লইয়াছিল। চারিত্রিক সনদপত্র অধ্যক্ষ সাহেব দিবেন না তো কে দিবেন। যাহাই হউক, গেলাম মহাবিদ্যালয়ের অধ্যক্ষের নিকট চারিত্রিক সনদপত্রের আশায়। মনে ভয় ছিল অধ্যক্ষ সাহেব কি আমাকে চিনিবেন ? কোন দিন তাঁহার সম্মুখে দাঁড়াইয়াছি বলিয়াওতো মনে পড়ে না। আর কেনই বা যাইব। তাহাকে কি আমার কোন কারণে দরকার হইয়াছে ? ভয়ে ভয়ে উনার কামরায় ঢুকিলাম। ভাবিলাম চরিত্র স¤পর্কে যদি খারাপ কিছু লিখিয়া দেন তবে কি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হইতে পারিব ? হায়, কি নির্বোধ ছিলাম আমি। সেদিন অধ্যক্ষের গালমন্দ খাইয়া হোচট খাইতে খাইতে করণিকের কামরায় প্রবেশ করিয়াছিলাম। তাহাকে চারিত্রিক সনদপত্রের কথা বলিতেই তিনি পান চিবাইতে চিবাইতে উত্তর দিলেন - “দশ টাকা বাইর কর”। আমি হতভম্ভের মত দশ টাকা বাহির করিয়া দিলাম। তিনি আমার নাম ধাম সব জিজ্ঞেস করিয়া একখানা ছাপানো কাগজ আমার হাতে ধরাইয়া দিলেন। আমি দেখিলাম - আমি নিদারূন দেশপ্রেমিক, কখনোই ঝগড়া ফ্যাসাদ করি নাই, অতি ভদ্র এবং উত্তম চরিত্রের অধিকারী - তাহা আগেই লেখা রহিয়াছে। ইহা ছাড়া অধ্যক্ষ সাহব নিজে সহি করিয়া বলিয়াছেন ‘আমি তাহাকে ব্যাক্তিগত ভাবে চিনি এবং সর্বাঙ্গীন মঙ্গল কামনা করি’। একটু আগের গালমন্দের কথা মনে পড়িল। করণিক সাহেবকে ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞাসা করিলাম - “ইহা কি যাহারা দ্বিতীয় বিভাগ পাইয়াছে তাহারাও পাইবে ?” (দুর্ভাগ্যবশতঃ আমি প্রথম বিভাগ পাইয়াছিলাম) উনি উত্তর দিলেন - “শুধু তাহারাই না সবাই পাইবে’। তার মানে সেই লিটন তরফদার, যে কিনা প্রকাশ্যে অস্ত্র হাতে নিয়া বিভিন্ন জনকে ভয়ভীতি প্রদর্শন করিয়া চাঁদাবাজি করিত এবং পরীক্ষায় অসদুপায় অবলম্বন করিয়া তৃতীয় বিভাগে পাশ করিয়াছিল তাহাকেও এরকম সনদপত্র দশ টাকার বিনিময়ে দেওয়া হইবে। যাহার মধ্যে একই কথা লিখা থাকিবে ? হায় দুর্ভাগ্য আমার, লিটন তরফদার দশ টাকা দিয়া নিজেকে ধুইয়া মুছিয়া একেবারে আদর্শ দেশ প্রেমিক, ভদ্র বিনয়ী এবং উত্তম চরিত্রের অধিকারী হইয়া আমার কাতারে আসিয়া দাড়াইল। মনের সেই খেদ মুছিতে আমার অনেক দিন লাগিয়াছিল।
ফিরিয়া যাই বি,সি,এস, পরীক্ষা প্রসঙ্গে। বন্ধু হান্নানকে সমস্যার কথা বলিতেই সে উত্তর দিল - ‘আরে এইডা কোন সমস্যা হইলনি, তুই কাগজপত্র নিয়া আয়’। আমি অবাক হইয়া বিস্মিতঃ দৃষ্টিতে তাহার পানে তাকাইলাম। সে তখন তাহার কাগজপত্র বাহির করিয়া আমাকে দেখাইল। আমি দেখিলাম উহাতে দিনাজপুর জেলার কোন এক কর্মকর্তার সীলমোহর সহ দস্তখত রহিয়াছে। ‘এত জায়গা থাকিতে দিনাজপুর হইতে সত্যায়িত করাইয়াছিস ?’ - আমি অবাক হইয়া জিজ্ঞাসা করিলাম। সে একগাল হাসিয়া আমাকে বোকাচন্দর বলিয়া গালিগালাজ করিয়া একখানা সীলমোহর বাহির করিয়াআমাকে দেখাইল। আমি জন্মলগ্ন হইতে নিতান্তই গোবর গণেশ। আমি উহার মর্ম বুঝিলাম না। বলিলাম ‘ইহাই বা তুই কোথায় পাইলি আর সেই কর্মকর্তাকেই বা আমি পাইব কোথায়’। হান্নান আমাকে পাগল ছাগল, গাধার লেজ ইত্যাদি বলিয়া গালিগালাজ করিয়া ব্যাপারটা বুঝাইয়া দিল।
আমি বোধকরি কথাবার্তায়া একেবারে অতীতে চলিয়া গিয়াছি। আমার বিষয় ছিল চাকুরীর দরখাস্তকরন। এ বিষয়ে এখনই বলিব। স্নাতোকোত্তর পরীক্ষার সনদপত্র পাইবার পর (যথাসময়ের দুই বছর পরে) নিয়োগ বিজ্ঞপ্তির আশায় পত্রপত্রিকা দেখিতে শুরূ করিলাম। অচিরেই আশানুরূপ নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি চোখে পড়িল। পদবি, বেতন এবং সুযোগ সুবিধা ইত্যাদি দেখিয়া মুহুর্তের মধ্যে টাকা-পয়সা, বাড়ি-গাড়ি, ঘুষ-নারী ইত্যাদি মস্তিস্কে তোলপাড় শুরূ করিল। যথাসময়ে দরখাস্ত লেখিয়া আমি আবারও সত্যায়ন সস্যায় পড়িলাম। কোথায় পাই প্রথম শ্রেনীর কর্মকর্তা ? বন্ধু হান্নানের সেই নির্ভেজাল পদ্ধতি ঝামেলামুক্ত (?) হইলেও আমি তাহা গ্রহন করিতে পারি নাই। ভয়ও পাইয়াছিলাম আবার বিবেকের দংশনও ছিল। উহা আবার আমাকে কারনে অকারনে মাঝেমধ্যেই কামড়াইয়া থাকে। তাই সেইবার বহু কষ্টে নিকটাত্মীয়ের মাধ্যমে একজন প্রথম শ্রেনীর কর্মকর্তা ধরিয়া রেহাই পাইয়াছিলাম। কিন্তু এইবার ? এইবার সমস্যা আরও বাড়িয়াছে। আগে ছিল একজন কর্মকর্তা কর্তৃক চারিত্রিক সনদ, এইবার দুইজন। কি মুশকিল ? চারিত্রিক সনদ দুইজন হইতে নিতে হইবে কেন ? নাকি দুইজনে চারিত্রিক সনদপত্র প্রদান করিলে চরিত্রের বৈশিষ্ট্য আরও মজবুত হইবে ? নাকি নিয়োগ কর্তারা হান্নান টেকনিক’ বুঝিয়া ফেলিয়াছেন। কিন্তু উনারা কি জানেন না যে হান্নানের জন্য ইহা মাত্র একঘন্টার ব্যাপার ? শুধু দোকানে যাইয়া খুলনা কিংবা চট্রগ্রামের কোন কর্মকর্তার সীলমোহর তৈরী করিয়া আনিতে হইবে। আর সেই সাথে হাতের কিছু নতুন ‘কেরিকেচার’। এ প্রসঙ্গে আর একজন ব্যাক্তির কথা আমার মনে পড়িতেছে। তাহার কথা ভাবিলে আমার নিজেরই লজ্জা হয। আমি যখন সবে বিশ্ববিদ্যালয়ে ঢুকি তখন তিনি ছিলেন হলের প্রভাবশালী নেতা। প্রসঙ্গক্রমে বলিয়া রাখি, তাহার কারনেই আমাকে একটি বিশেষ রাজনৈতিক দলে যোগ দিতে হয়, যাহার ফলে তাহার উপর আমার কিঞ্চিত রাগও ছিল। সে যখন চলিয়া যায় যায় অবস্থায় তখন আমি নিজেই হলের একজন হর্তাকর্তা (বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির পর ক্রমশঃ আমার বুদ্ধিবৃত্তির আশাব্যাঞ্জক পরিবর্তন ঘটিয়াছে!) একদিন উপর মহল হইতে খবর পাইলাম আমাদের সেই বড়ভাই তিনতলার একটি কক্ষ একা দখল করিয়া রাখিয়াছে এবং আমার উপরই হুকুম হইল উহার কর্তৃত্ব লওয়ার। সেইদিনই রাত্রিরে আমি আমার বাহিনী লইয়া হুমহাম করিয়া উক্ত কক্ষের কর্তৃত্ব লইলাম। কক্ষের অবস্থার কথা বর্ণনা করিয়া পাঠককে বিব্রত করিব না। শুধু এইটুকু বলিতে পারি উহা মানুষের বসবাসের অযোগ্য ছিল। সেই কক্ষে আমি পাইয়াছিলাম এক ব্যাগ সীলমোহর। অমুক জেলার কর্মকর্তা, অমুক থানার ম্যাজিস্ট্রেট, কলেজের অধ্যাপক হেন পদবী বাকি নাই যাহার সীলমোহর ওখানে ছিলনা। ভাইটি আবার এক রাজনৈতিক দল হইতে কেন্দ্রীয়ভাবে নির্বাচন করিয়া ছাত্র সংসদে অবস্থান করিয়া লইয়াছিল। নির্বাচনের আগে তাহার যে নির্বাচনী লিফলেট ছিল তাহাতে লেখা ছিল - ‘রাজ্জাক মোল্লা জিতবেই, কারণ সে ভদ্র ও বিনয়ী’। আর সেই ভদ্র ও বিনয়ী মোল্লা সাহেবের এহেন কর্মকান্ড দেখিয়া আমরা বিস্ময়ে হতবাক হইয়া গিয়াছিলাম।
প্রসঙ্গেঃ ফিরিয়া যাই। চাকুরীর নিয়োগে দুইজন কেন, দশজন কর্মকর্তার নিকট হইতে চারিত্রিক সনদপত্র চাওয়া হইলেও হান্নান বা রাজ্জাক মোল্লার মত ছেলেদের জন্য তাহা কোন সমস্যা হইবেনা। সমস্যায় পড়িব আমরা - যাহারা ক্ষুদ্র বিবেক সম্পন্ন নির্বোধ। আর যা অবস্থা দেখিতেছি, সামনে হয়তো চাকুরীদাতা তিন চারজন প্রথমশ্রেনীর কর্মকর্তার নিকট হইতে চারিত্রিক সনদপত্র চাহিয়া বসিবেন। তখন আমার মত ভূক্তভোগীরাই বিপদে পড়িবে। তখন বলা যায়না, বাধ্য হইয়া আমাদেরও হয়তো ‘হান্নান টেকনিক’ বাছিয়া লইতে হইবে। (এইভাবে যে চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের দু‘একটা দিক বিনষ্ট হইবার উপক্রম হইবে তাহা কি কেহ ভাবিয়া দেখিবেন?)
ইউনিয়ন পরিষদের নিকট হইতে নাগরিকত্বের সনদপত্র আনিতে গিয়া নতুন অভিজ্ঞতা অর্জিত হইল। অফিসের করণিককে নাগরিকত্বের সনদপত্রের কথা বলিতেই উনি আমাকে জিজ্ঞেস করিলেন - ‘কয়খানা লাগিবে?’ আমি খুব একটা অবাক হইলাম না। বলিলাম - ‘দুইখানা হইলেই চলিবে’। তিনি বলিলেন - ‘পার পিচ পাঁচ টাকা’। আমি বলিলাম - ‘লে হালুয়া, একি মাছের টুকরা?’ তিনি আমাকে পাঁচ টাকার বিনিময়ে ‘দুই পিচ’ নাগরিকত্বের সনদপত্র দিয়া দিলেন এবং যথাযথ ভাবে পূরণ করিয়া লইতে বলিলেন। আমার নাম-ধাম-গ্রাম কিছুই জিজ্ঞেস করিলেন না। আমি এই গ্রহের বাসিন্দা নাকি অন্য জগতের মানুষ তাহাতে তাহার বিন্দুমাত্র মাথাব্যাথা নাই আর তিনিই কিনা বিতরণ করেন নাগরিকত্বের সনদপত্র!
আর একটি ঘটনার উল্লেখ করিয়া উপসংহার টানিব। ঘটনাটি ঘটিয়াছে সাম্প্রতিককালে একটি চাকুরীর দরখাস্ত করিতে গিয়া। গিয়াছিলাম যথারীতি এক অফিসে সনদপত্র সত্যায়ন করিতে। কর্তা সাহেব যাবতীয় সনদপত্র সত্যায়ন করিয়া দিলেন। এমনকি চারিত্রিক সনদপত্রও দিলেন। যদিও তিনি আমাকে আগে কোনদিন দেখেন নাই। বিপত্তি ঘটিল আরেকজন প্রথমশ্রেনীর কর্মকর্তার অভাবে। কারন চাকুরীদাতা দুইজন কর্তৃক চারিত্রিক সনদপত্র চাহিয়াছেন। কি করি ... ... শেষে উনিই উপায় বাতলাইয়া দিলেন। বলিলেন অমুক তলায় অমুক কক্ষে একজন প্রথম শ্রেনীর কর্মকর্তা আছেন। উনার নিকট যাও। অগত্যা কাগজপত্র লইয়া খোজাখুজি করিয়া উক্ত কক্ষের সন্ধান পাইলাম। দরজায় দাড়াইয়া বলিলাম - ‘ভিতরে আসিতে পারি?’ ভদ্রলোক অনুমতি দিলেন। আমি সালাম জানাইয়া ভিতরে প্রবেশ করিয়া দেখিলাম এক শান্ত সৌম্য টুপী পাঞ্জাবী পরিহিত ভদ্রলোক বসিয়া আছেন। উনাকে অতিমাত্রায় সৎ লোক বলিয়া মনে হইল। আর তাহাতেই আমার মনে সন্দেহ জাগিল। উনি চারিত্রিক সনদপত্র দিবেন তো? উনার জিজ্ঞাসু দৃষ্টির পানে তাকাইয়া সংবিত ফিরিয়া পাইলাম। তাহাকে তাড়াতাড়ি আমার সমস্যার কথা জানাইলাম। উনি প্রথমেই না করিয়া ফেলিলেন। বলিলেন আমি কাগজপত্র সত্যায়ন করিনা। আমি বলিলাম আমাকে অমুক ব্যাক্তি পাঠাইয়াছেন। এই বলিয়া আমি আমার সদ্য সত্যায়িত কাগজপত্রগুলো তাহার সম্মূখে তুলিয়া ধরিলাম। তিনি বিরক্ত বোধ করিলেন। কিন্তু আমি নাছোড়বান্দা বুঝিতে পারিয়া বলিলেন - ‘ঠিক আছে মূল কপি এবং অনুলিপি গুলো আমাকে দাও’। আমি তখন ভয়ে ভয়ে বলিলাম - ‘আসলে আমি আসিয়াছি একটা চারিত্রিক সনদপত্র নিতে। এটা ঠিক সত্যায়ন নয়। চাকুরীর দরখাস্ত করিতে এখন দুইখানা সনদপত্র লাগে ... ... ... আমি হরবর করিয়া সবকিছু বলিতে লাগিলাম। তিনি এমনভাবে আমার দিকে তাকাইয়া রহিলেন যেন আমি সাক্ষাত শয়তান। তাহাকে কুমন্ত্রণা দিতে আসিয়াছি। আমি তাড়াতাড়ি পূর্ববর্তী ভদ্রলোকের দেওয়া চারিত্রিক সনদপত্র খানা তাহার সম্মুখে তুলিয়া ধরিয়া বলিলাম - ‘দেখুন উনি যদি দিতে পারেন তাহা হইলে আপনিও নিশ্চয়ই দিতে পারিবেন। আর তাহাছাড়া আপনারা না দিলে আমরা কোথায় যাইব ... ... আবার একগাদা কথা বলিয়া ফেলিলাম। তিনি মনে হইল একটু চিন্তায়ই পড়িলেন। একজন বিপদগ্রস্থ ছেলে আর তাহাছাড়া ... ...। ‘কিন্তু তুমি যে সচচরিত্রবান ছেলে তাহার প্রমান কি?’ - তিনি জিজ্ঞেস করিলেন। এই বার আমি পড়িলাম গ্যাড়াকলে। কি করিয়া এখন আমি আমার চরিত্রের প্রমান দেই? কি বলি কি বলি শেষে আমতা আমতা করিয়া নিজের চরিত্রের পক্ষে সাফাই গাইবার চেষ্টা করিলাম - ‘দেখুন যে ছেলে জীবনের সকল পরীক্ষায় প্রথম শ্রেনী পাইয়া আসিয়াছে সে কি করিয়া দুশ্চরিত্র হইতে পারে? আপনিই বলুন। এভাবে আরও দু’একটা উদাহরন দেওয়ার চেষ্টা করিলাম। তিনি তীক্ষ্ন দৃষ্টি মেলিয়া আমার দিকে তাকাইয়া রহিলেন। হয়তো বা দৃষ্টি শক্তি দিয়া মাপিবার চেষ্টা করিতেছেন আমার চরিত্র। আমিও হাতদুখানা এক করিয়া মুখখানায় একখানা কার্টুন মার্কা হাসি ফুটাইয়া তুলিলাম। এরপর তিনি আমার শিক্ষাগত যোগ্যতার যাবতীয় সনদপত্র খুটাইয়া খুটাইয়া দেখিলেন। তাহারপর দয়া করিয়া সেই সনদপত্র খানা পড়িতে শুরূ করিলেন যাহাতে তাহার দস্তখত পড়িলে আমি আমার চরিত্র সম্পর্কে নিঃসন্দিহান হইতে পারি। ‘কিন্তু’ - তিনি শুরূ করিলেন আর তাহাতেই আমার ভিতর কম্পন শুরূ হইল - ‘এই যে কথাটা লিখিয়াছ “আমি তাহাকে ব্যাক্তিগত ভাবে চিনি” এই কথাটাতো ঠিক না। আমি তো তোমাকে চিনি না’। চেয়ারে হেলান দিয়ে সদ্যজেতা যুদ্ধনায়কের মত তাকাইলেন তিনি আমার দিকে। এইদিকে আমার ধৈর্য্যরে বাধ ভাঙ্গিয়া যাইতেছে। এত সৎ মানুষ হইলেতো সমস্যা। আমি রাগ চাপিয়া বলিলাম -‘আজ তো আপনি আমাকে বেশ ভালভাবেই চিনিলেন। আগামীকাল যদি আমি আবার আসি তবে কি আপনি দিবেন?’ - মনে ভয় ছিল না জানি কি বলিয়া বসেন। কক্ষ হইতে বাহির করিয়াও দিতে পারেন। কিন্তু না। ভদ্রলোক কলমদানী হইতে কলমখানা লইলেন। তারপর আমার চরিত্রের গ্যারান্টী স্বরূপ দস্তখত করিয়া বলিলেন - ‘ঠিক আছে আজই শুধু দিলাম। কিন্তু ভবিষ্যতে আর দিব না।’ আমি মনে মনে বলিলাম শুকুর আলহামদু ... ... । কাগজপত্র গুছাইয়া বাহির হইতেছি। তিনি বলিলেন- ‘কিন্তু ঐ যে লিখেছ “আমি তাহাকে ব্যাক্তিগত ভাবে চিনি”, ঐ কথাটি ঠিক না’। বুঝিলাম তিনিও আমার মত অতি বিবেকসম্পন্ন। হয়তো কথাটা তাহার মাথায় টোকাইতেছে। আমি তাড়াতাড়ি সালাম জানাইয়া কাটিয়া পড়িলাম। মনে ভাবিলাম - ‘দেশটা সৎ মানুষে থুড়ি সৎ প্রথম শ্রেনীর কর্মকর্তায় ভরিয়া গেলে যে কি হইত?’
শুরূতে প্রথম শ্রেনীর কর্মকর্তার অবতারণা করিতে গিয়া ‘অজানা অচেনা’ বিশেষন যোগ করিয়াছিলাম। কারণ আমি এমন এক পরিবারে জন্মগ্রহন করিয়াছি যাহার চৌদ্দপুরূষ হাতড়াইলেও কোন প্রথমশ্রেনীর কর্মকর্তা খুজিয়া পাওয়া যাইবেনা। যাহার ফলে আমাকেই অনেক হাতড়াইয়া প্রথমশ্রেনীর কর্মকর্তা বাহির করিতে হয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের জনৈক প্রভাষককে জিজ্ঞেস করিয়াছিলাম তাহারা কেন সত্যায়ন কিংবা চারিত্রিক সনদপত্র দিতে পারেননা। তিনি উত্তরে বলিয়াছিলেন - ‘আমরা তো গেজেটেড কর্মকর্তা নই।’ হায়রে দুর্ভাগ্য আমার। যেখানে ৫/৬ বৎসর অধ্যয়ন করিলাম সেখানকার শিক্ষকদেরই সত্যায়ন বা চারিত্রিক সনদপত্র দিবার ক্ষমতা নাই আর ওদিকে প্রথমশ্রেনীর কর্মকর্তা হইলেই তিনি সচচরিত্র বিতরণ করিবার ক্ষমতা রাখেন। কেন? চারিত্রিক সনদপত্র প্রথমশ্রেনীর কর্মকর্তা দিবেন কেন? এমন ব্যবস্থা হইলে কি ভালো হইতো না যে বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ শেষে শিক্ষাগত যোগ্যতার সনদপত্রের পাশাপাশি চারিত্রিক সনদপত্রও দেওয়া হইবে। যাহাতে নূন্যতম দুইটি শ্রেনী থাকিবে। যাহারা নিয়ম শৃংখলা মানিয়া অধ্যয়ন করিয়াছে তাহারা অপেক্ষাকৃত ভালো শ্রেনীর চারিত্রিক সনদপত্র অর্জন করিবে। ইহাতে বিশ্ববিদ্যালয়ে সন্ত্রাসের পরিমান কিছুটা হইলেও হ্রাস পাইতো। আর আমার মত রাজনৈতিক ব্যাক্তিত্বের অধিকারী ছাত্ররা যে পড়াশোনা ও নিয়ম শৃংখলায় বেশী মনোযোগী হইতো তাহা অšততঃ জোর গলায় বলা যায়। লিটন তরফদারের কথা মনে পড়িতেছে। চারিত্রিক সনদপত্রে দুইটি শ্রেনী থাকিলে তাহারও মনে ভয় থাকিত। চরিত্রের উপর কালিমা লেপন কাহার ভালো লাগে? আর বর্তমান অবস্থা এমন মনে হইতেছে যাহাদের প্রথমশ্রেনীর আত্মীয় স্বজন রহিয়াছে তাহারাই সচচরিত্রবান আর যাহাদের এরূপ আত্মীয় নাই তাহাদের চরিত্রের কোন গ্যারান্টী নাই।

আমি দ্বিপৃর বাবা বলছি

(বি.দ্র.: একান্তই নিজের সুখ দুঃখ নিয়ে এই লেখা)
আজ আমার প্রথম সন্তানের ৫ম জন্মদিন। ২০০২ সালের এই দিনে বেলা ১১ টায় আমার ছেলের জন্ম। আমি তখন বগুড়ায়। যমুনার পাড়ের কোন এক গ্রামে বন্যার্ত মানুষের মাঝে ত্রানসামগ্রী বিতরনের কাজে ব্যস্ত। দীর্ঘ লাইনে দাড়িয়ে দরিদ্র মানুষগুলো। ডিস্ট্রিবিউশন টিমের লিডার হিসাবে এপাশ ওপাশ দৌড়াচ্ছি; কখনো নিজেই ত্রান সামগ্রী উঠিয়ে দিচ্ছি মানুষের হাতে। বেলা ২টার মত হবে - তখন খবরটা পাই আমি। ঢাকায় আসতে আসতে সন্ধা হয়ে যায়।
সেদিন আমার স্ত্রী তার অফিসে যাবার প্রস্তুতি নিচ্ছিল। এ সময় তার শারীরিক সমস্যা শুরু হয়। ওকে তাড়াতাড়ি মনোয়ারা হসপিটালে নিয়ে যাওয়া হয়। বেলা এগারটার সময় প্রথম সন্তানের আগমন এই পৃথিবীতে। প্রত্যাশিত দিনের ৪ সপ্তাহ আগেই জন্ম হয় ওর। আমি জানিনা কোথায় সমস্যা ছিল, কেন সমস্যা হয়েছিল; শুধু এটুকু জানি জন্মগতভাবে আমার ছেলেটার মাথায় ছোট্ট একটা সিস্ট হয়। যার কারনে একটা নির্দিষ্ট সময় পর পর সবসময় তার খিঁচুনী হত। খিচুনীর চরম পর্যায়ে হাসপাতাল। কমে গেলে বাসায়। বাড়লে আবার হাসপাতাল। এভাবেই চলছিল তার জীবন। তবে সুস্থ থাকাকালীন সময়ে কখনোই মনে হত না ও যে অসুস্থ। তার অসুস্থতাকালীন সময়ে মোট দু’বার রক্তের প্রয়োজন হয়। ওর মামা দুবারই ওকে রক্ত দেয়। ওর মামা না থাকলে আমাকে রক্তের সন্ধানে দৌড়াতে হত নিশ্চয়ই।
খিচুনীর সময়গুলোতে ও যখন হাসপাতালে কষ্ট পেত তখন আমি বউকে স্বান্তনা দিতাম। সবাই আমার নির্লিপ্ত মুখ দেখতে পেত। আর আমি সবার অগোচরে রাস্তায় নেমে জোরে জোরে অথচ নিঃশব্দে কাঁদতাম। কেঁদে কেঁদে যখন ভিতরটা হাল্কা হত তখন আবার নির্লিপ্ত মুখে ফিরে যেতাম। অনেকেই আমার নির্লিপ্ততা দেখে অবাক হত। প্রতিবারই আমি মনে মনে সৃষ্টিকর্তার কাছে শক্ত শপথ নিতাম; আমার ছেলের কিছু হলে সব ধংস করে ফেলব। চুরমার করে ফেলব চারিদিক। তারপর সাময়িক সুস্থ হলে ছেলেকে নিয়ে বিজয়ীর বেশে বাসায় ফিরতাম।
যাই হোক, বেশী কথা বাড়াব না। ধীরে ধীরে আলোচনা করে সহানুভুতি আদায় করার মত হয়ে যাচ্ছে বিষয়টা। যা বলতে চাই তা হচ্ছে - আমার ছেলেটা মারা গেছে প্রায় তিন বছর বয়সে (৩৪ দিন কম)। এই তিন বছর জীবনে ছেলেটা প্রচন্ড কষ্ট পেয়েছে। ওর জীবনের বড় একটা সময় কেটেছে সেন্ট্রাল হাসপাতালে (ধানমন্ডী, ঢাকা)। শেষ সময়টুকুও ঐ হাসপাতালেই।
সৃষ্টিকর্তা ভালই খেলেছিলেন আমার সাথে। সন্তানের মৃত্যুর পর খুব বেশীদিন লাগেনি তাকে ভুলে যেতে। সেই শক্ত শপথের কথাও মনে রাখিনি। আবার দৈনিন্দিন জীবন যাপনে ব্যস্ত হয়ে পড়েছি। যদিও মাঝে মাঝেই আমরা দুজন একসঙ্গে কাঁদতাম। তবে যে মাসে আমার ছেলে মারা যায় তার পরের মাসেই আমি বাসা বদল করে ফেলেছিলাম। আবার নতুন করে সব কিছু শুরু করার প্রত্যয়ে। নতুন বাসায় জন্ম হয় আমার মেয়ের - আমার দ্বিতীয় পৃথিবীর।
এরই মধ্যে আমার মেয়ের বয়স দুই বছর পার হয়ে গেছে। আমি আবারো বাসা বদল করে আমার অফিসের কাছাকাছি চলে এসেছি। কারন একটাই। আমার মেয়ে। প্রতিদিন দুপুরে বাসায় যাই। খাই আর তার সঙ্গে কিছুক্ষন সময় কাটাই। এভাবেই চলছে আমার জীবন। তবে ইদানীং একটু ঝামেলা হচ্ছে। মাসখানেক আগেও মেয়েকে ভুলিয়ে ভালিয়ে রেখে আসতে পারতাম। আমার পিছু নিলেই ওকে বলতাম 'আববু, বলতো তোমার জন্য কি আনব?' ও তখন মাথা নাড়িয়ে উত্তর দিত 'দুছ (জুস) আর চিপ' তারপর 'টাটা বাইবাই' বলে বিদায় জানাত। এখন আর ওভাবে বিদায় দেয় না। আমাকে দেখতে না পেলেই ’আব্বু নাই আব্বু নাই’ বলে কান্না জুড়ে দেয়। আর বের হবার সময় 'আমি আমি' 'আমি হাইট্টা' বলে নিজের জুতোজোড়া পরে আমার পিছু নেয়। অর্থ্যাৎ আমার সাথে হাটতে বের হবে। এ কারনে গত কয়েকদিন যাবৎ নতুন পথ বেছে নিতে হয়েছে। ওর মা ওকে ভুলিয়ে ভালিয়ে রাখে দুরে সরিয়ে নিয়ে যায়। আমি চুপ করে পালিয়ে আসি।
মেয়েটাই এখন আমার সব। প্রতিদিনই আমার সুখ দুখ হাসির মাঝে আমার মেয়ে। ছেলের কথা আমার এখন ভুলেও মনে পড়েনা। গত তিন বছরে অনেকবারই গ্রামের বাড়িতে গিয়েছি। কিন্তু কখনো যাইনি আমার ছেলের কবরের কাছে। আমার ছেলের নাম রাওয়াদ। আমি আদর করে ডাকি ভুটু। আমার দ্বিতীয় পৃথিবী ছিল সে। তাই ভুটু। আমি ছিলাম ভুটুর বাবা। আমার স্ত্রীও আমাকে মাঝে মধ্যে ওভাবে ডাকত। ভুটু চলে যাবার পর আমার দ্বিতীয় পৃথিবী হারিয়ে ছিল কিছুদিন। দুবছর আগে আমি আবার আমার দ্বিতীয় পৃথিবী ফিরে পেয়েছি। আমার দ্বিতীয় পৃথিবী আমার মেয়ে - দ্বিপৃ। ওটাই ওর নাম। এখন আমি দ্বিতীয় পৃথিবীর পিতা। দ্বিপৃর বাবা।
পুনশ্চ: আমি তৃতীয় পৃথিবীর অপেক্ষায় আছি। দুমাস পরে ওর মাটির পৃথিবীতে আসার কথা রয়েছে। ও এখন অদ্ভুত এক জগতে বাস করে। ভাবলেই অবাক হই - আমি তিন ভুবনের তিন সন্তানের পিতা! আমার মত ভাগ্যবান এ সময়ে আর কি কেউ আছে?

যাদুকর

১.'হ্যা ভাই, দেখেন, এই যে দেখেন আমার হাতে একটা পয়সা। এই আমি ছুমন্তর দিয়া দিলাম।' - হাতের কয়েনটা মুখের কাছে এনে ফু দেয় শমশের। -'হা হা এই যে এইবার দেখেন।' - দুই হাতের তালু এক করে তালুর ভেতর পয়সাটা নিয়ে নেয় সে। তারপর সশব্দে সুর করে মন্ত্র উচ্চারন করতে থাকে-
হুলা বিলাইএর তিন ঠ্যাঙইন্দুর আইয়া মারল ল্যাংতাই দেইখা নাচে বান্দরদেখা গেল খুবি সোন্দরদিলাম মন্ত্র কইসাবাইর হইব এইবার পয়সাপয়সা বাইর হ পয়সা
বিছিয়ে রাখা মাদুরে হাটু গেড়ে বসে দুই হাতের তালু ঘসতে থাকে সে। তালুর ভিতর থেকে ঝুর ঝুর করে মাটিতে পড়তে থাকে একটাকা পাঁচটাকার কয়েন গুলো।
মনে মনে খুবই বিরক্ত আজ শমশের। এরই মধ্যে দুইবার আসর বসিয়েছে সে আজ। প্রথমবার তো একেবারে ফাউ গেছে। অল্প কয়েকজন লোক দাড়িয়েছিল হাটে যাবার সময়। এক ফাইল ওষুধও বেচতে পারেনি। এইবারও মনে হচ্ছে খুব একটা সুবিধা হবে না।
যাদুর খেলা দেখানোর পর্ব শেষ। মানুষকে আকৃষ্ট করার প্রাথমিক প্রচেষ্টা কিছুটা সফল। অল্প কিছু মানুষ গোল হয়ে দাড়িয়ে গেছে। এইবার ব্যাবসার ধান্ধা শুরু করা যায়।
'হ্যা ভাই, মন দিয়া শুনেন। দাঁত থাকতে বাঙালী দাঁতের মর্যাদা বুঝে না...। বাসর রাইতে নয়া বউ যখন বুইড়া ভাইবা খিচা দৌড় দিবো হেইদিন বুঝবেন দাঁত কি জিনিস...।' - শমশের তার 'বিখ্যাত' দাতের মাজন বিক্রির উদ্দেশ্যে চলাচলকারী মানুষগুলোকে কথায় ভুলিয়ে আকৃষ্ট করার চেষ্টা করে।
হাটে যাবার পথে মানুষগুলোর কেউ থমকে দাড়ায়; কেউ ঠেলে উকি দেয় ভিতরে। এদের ভিতর থেকেই কেউ কেউ শমশেরের চটকদার কথাবার্তায় মজে গিয়ে বসে পড়ে তার মজমায়।
'আমার এই দাঁতের মাজন এক মিনিটেই আপনের দাঁত ফকফকা সাদা কইরা ফালাইবো। দাতের কুনাকাঞ্চিতে যত ব্যাথা আছে সব এক নিমিশে খতম হইয়া যাইবো।'
'তোমার ওষুধতো কাম করে না।' - হঠাৎ কেউ একজন মন্তব্য করে ওঠে।
শমশের আড় চোখে তাকায় মন্তব্যকারীর দিকে। মনে মনে ওর মা'বোন তুলে গালি দেয়। তার ব্যবসা লাটে উঠানোর মতলব? কিন্তু মুখে মধুর হাসি ফুটিয়ে তোলে - 'ভাই, আমি আপনেরে যেইভাবে কইছিলাম আপনে তো সেইভাবে ব্যাভার করেন নাই। দাঁত পরিস্কার হইব কেমনে? গরম পানির মধ্যে দুই চিমটি লবন মিশাইয়া গার্গল কইরা তারপর মাজতে কইছিলাম। আপনে তা করেন নাই।'
লোকটি আরো কিছু বলার জন্য মুখ খোলা মাত্রই সে তার মুখের কথা কেড়ে নিয়ে ধমকের শুরে আবার বলতে থাকে - 'দেখেন ভাইসব - এই ভাইজান পয়সা দিয়া আমার কাছ থিকা মাজন কিনছে। কিন্তু নিয়ম মানে নাই। আরে বাঙালী সবজায়গায় নিয়ম ভাঙতে ওস্তাদ...'
এ যাত্রা বেশ কয়েক ফাইল ওষুধ বিক্রি করে ফেলে সে।
২.সদ্য বিক্রী করে পাওয়া টাকাপয়সা গুনছিল শমশের। আর একবার আসর বসাবে কিনা ভাবছে। আকাশের দিকে তাকায় একবার। বেলা তো রয়েই গেছে। হঠাৎ সামনে খেয়াল করল সে, ছোট সেই ছেলেটি কাঁদছে। আসরে ছিল ছেলেটি প্রথম থেকেই। মলিন চেহারা। সবাই চলে গেলেও সে বসে আছে আগের যায়গায়।
'এই পোলা এইদিকে আহো।' - শমশের হাত ইশারায় ডাকে ছেলেটিকে।
ধীরে ধীরে উঠে আসে ছেলেটি। দুইগালে গড়িয়ে পড়া অশ্রুধারার আভাস। শমশেরের ইশারায় ওর সামনে বসে পরে সে।
'তুমি কান্দ কেন? কি হইছে তোমার?'
'আইজ সকাল থিকা কিছু খাই নাই।' - আনমনে নখদিয়ে মাটি খুটে ছেলেটি।
'কেন মায় ধইরা মারছে?'
ছেলেটি ডানে বায়ে মাথা নাড়ে!
'তাইলে কি হইছে?'
হু হু করে কেদে ওঠে ছেলেটি -'বাইত মায়ও সকাল থিকা না খায়া হুইয়া রইছে। মায়ের অশুখ। মায় কইছে হাটে থিকা ভিক্ষা কইরা ট্যাকা নিয়া ওষুধ নিয়া যাইতে। আমি কোনদিন ভিক্ষা করি নাই। '
শমশের শুধু বলে -'আহারে'। আর কিছু বলতে পারে না সে। আজ তার নিজের ঘরেও চাল নেই। সন্ধ্যে বেলা বাজার করে নিয়ে যেতে হবে তবেই খাওয়া।
'আফনে আমারে একটা কাম কইরা দিবাইন?'- ছেলেটির চোখমুখ একটু ঝলমল করে উঠে।
'কি কাম কও?' - শমশের শুধায়।
'আপনে তো যাদু কইরা একটাকা থিকা অনেক টাকা বানাই ফেলান। এই দেহেন আমার কাছে একটাকা আছে। দেন না আমারে অনেক ট্যাকা বানায়া। '- আশা ফুটে ওঠে ছেলেটির চোখে।
ছেলেটার করুন মুখের দিকে তাকিয়ে মনে মনে একটু কষ্টই অনুভব করে শমশের। হায়রে, সে যে হাত সাফাই করে মানুষকে মজা দেবার উদ্দেশ্যে এই কান্ড করে তার ওষুধ বিক্রী করার জন্য - এ সামান্য বিষয়টা বোঝার ক্ষমতা এই ছেলের নেই।
'আরে পোলা শুন; আমিতো' - আসল কথাটা বলতে গিয়েও কি ভেবে আবার থেমে যায় সে। একটুকরো মলিন হাসি ফুটে উঠে তার মুখে।
'ঠিক আছে তোমার পয়সাটা দেও দেহি আমারে।'
ছেলেটি তার কয়েনটি তুলে দেয় যাদুকরের হাতে।
শমশের কয়েন হাতে নিয়ে তার কৌশল শুরু করে। - 'এই দেখ এই আমার হাতে একটা পয়সা। এই আমি ছু মন্ত্র দিয়া দিলাম।' - ফু দেয় সে তার হাতের কয়েনে। তারপর শশব্দে তার প্রচলিত মন্ত্র শুরু করতে গিয়েও হঠাৎ থেমে যায়। কি ভেবে সৃষ্টিকর্তার কাছে প্রার্থনা করতে শুরু করে সে। সে বিড়বিড় করে বলতে থাকে - 'হে খোদা! জীবনে তোমার কাছে কোনদিন কিছু চাই নাই। আইজকা বিপদে পইড়া তোমারে ডাকি। আইজকা একবারের জন্য তুমি আমার যাদু সত্য কইরা দাও। একবারের জন্য আমার যাদু সত্য কইরা দেও খোদা।'
তার চোখের কোনে অশ্রু জমে ওঠে। হাটু গেড়ে বসে সে খালি হাতের তালু দুটো জোরে জোরে ঘসতে থাকে। তার মনে ক্ষীন আশা জেগে উঠে। বিধাতা আজ তার ডাক শুনবেন মনে হচ্ছে! তার সারা গায়ে হঠাৎ রক্তের ঝিলিক দিয়ে উঠে; শরীরের রোমগুলো দাড়িয়ে যায়! খোদা তার প্রার্থনা পুরন করবেনই আজ! খালি হাতের তালু দুটো আরো জোরে ঘসতে থাকে সে।
শমশের ভুল করে। বিধাতা যে এ ধরনের ডাকে কখনো সাড়া দেন না তা বুঝতে পারে না শমশেররা। মানুষের কান্নাকাটি, অনুরোধ, উপরোধের থোড়াই কেয়ার করেন তিনি।
এদিকে ছেলেটি অবাক হয়ে হাতের দিকে তাকিয়ে থাকে। 'কই, পয়সা তো বের হচ্ছে না! ঘটনা কি? ও হ্যা তাইত' - হঠাৎই তার মনে হয় - 'যাদুকর তো মন্ত্র পড়েনি। সে জন্যই কি--?'
সে দ্রুত যাদুকরের হাত চেপে ধরে, তারপর কানের কাছে ফিসফিস করে বলতে থাকে -'আপনে তো মন্ত্র কন নাই।'
'ও হ তাইতো' - গলাটা একটু কেপে যায় শমশেরের। বিধাতা তার ডাকে সাড়া না দেয়ায় অভিমানী হয়ে ওঠে সে। চোখ থেকে টুপ করে একফোটা পানি ঝড়ে পড়ে। - 'তুমার দিলে দয়া মায়া নাও থাকবার পারে। ভাবতাছ আমার নাই? আমারে তুমি কি মনে করছ?' - মনে মনে ভাবে আর ক্ষোভে ফুঁসতে থাকে সে।
ছেলেটার দিকে তাকিয়ে দাঁতে দাঁত চেপে সে বলতে থাকে -'তাইতো কই পয়সা বাইর হইতেছে না ক্যান। মন্ত্রই তো পড়ি নাই।'
সে আবার শুরু করে প্রথম থেকে। 'এই যে দেখ তোমার পয়সা। এই আমি ছুমন্তর দিয়া দিলাম।' দুই হাতের তালুর ভেতর পয়সা ঢুকিয়ে রাখে সে। তারপর শশব্দে মন্ত্র পড়তে শুরু করে -
হুলা বিলাইএর তিন ঠ্যাঙইন্দুর আইয়া মারল ল্যাংতাই দেইখা নাচে বান্দরদেখা গেল খুবি সোন্দরদিলাম মন্ত্র কইসাবাইর হইব এইবার পয়সাপয়সা বাইর হ পয়সা
ইশারায় ছেলেটিকে তার হাতের নিচে হাত পাততে বলে সে। ছেলেটি হাত পাতে শমশেরের ঘসতে থাকা দুই তালুর নিচে।
ঝুরঝুর করে তার হাতে একটাকা, পাঁচটাকার কয়েন পড়তে থাকে। আনন্দে চোখ চকচক করে ওঠে বালকের। আরে আশ্চর্য, পঞ্চাশ টাকার একটা নোটও বের হয়ে এল দেখি হাতের ভিতর থেকে!
বিষ্ময়ে অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে ছোট্ট ছেলেটি। যাদুকরের কত ক্ষমতা!
'এইবেলা বড় যাদু কইরা বড় নোট বাইর করলাম। এখন যাও, ডাক্তরের কাছ থিকা ওষুধ নিয়া যাও, আর বাকি ট্যাকা দিয়া মায়ের লিগা কিছু খাওন কিনা নিও।' - ছেলেটিকে আড়াল করে ঘাড়ের গামছা দিয়ে চোখ মুছে সে। তার নিজের বাড়িতে আজ রান্না হবে কি?
ছেলেটি হাতে টাকা পয়সা গুলো নিয়ে নির্বাক হয়ে তাকিয়ে থাকে যাদুকরের দিকে।
'খাড়াইয়া রইলা কেন যাও; আর ট্যাকা পয়সা সাবধানে নিয়া যাইও। হারাইওনা।'
সংবিত ফিরে পায় ছেলেটি। আর দাড়ায় না সে। হাটের ভিতর ছুটে যায় ওষুধের দোকান লক্ষ্য করে।
শমশের উঠে দাড়ায়। শেষ বিকেলে হাটুরে লোকজনের চলাফেরা কিছুটা বেড়ে গেছে ইতোমধ্যে। আবার সে তার বাক্স সাজায়। নতুন উদ্দমে শুরু করে -'আসেন ভাইসব দেখেন। যাদুর খেলা দেখেন। খেলা দেখেন আর জরুরী খবর শোনেন। দাঁত বিষয়ক অতি জরুরী খবর। হায় বাঙালী, দাঁত থাকতে দাতের মর্যাদা বুঝলা না...বাসর রাইতে যখন বউ...'
কেউ একনজর দিয়ে চলে যায় আবার কেউ দাড়ায়। ধীরে ধীরে আবার লোকজন জড়ো হতে থাকে তার চারপাশে।
'এই দ্যাখেন আমার হাতে একটা পয়সা--' যাদুকর শমশের আবার তার যাদুর খেলা শুরু করে।
ওদিকে একহাতে ওষুধ আর অন্য হাতে খাবার নিয়ে বাড়ির পথে ছুটে চলে ছেলেটি যেখানে তার প্রতিক্ষায় চেয়ে রয়েছে তার মমতাময়ী মা।