Tuesday, September 2, 2008

বিশ্বাস

’বিশ্বাস করতে পারলিনা তো একদিন পস্তাবি’ - লোকটির এই কথাগুলো বার বার মনে হচ্ছে। আজ সপ্তম দিন। গত সাত দিনে ৫ টাকার ৭ টা চকচকে কয়েন পেয়েছি আমি বিভিন্ন জায়গায়, বিভিন্ন ভাবে। তবে আজকের পাওয়াটা খুবই অদ্ভুত কিছুটা অলৌকিক মনে হচ্ছে।
আমার জীবনে এ পর্যন্ত কোন অলৌকিক ঘটনা ঘটেনি; বড় কোন দুর্ঘটনাও ঘটেনি। বড়ই সাদামাটা জীবন আমার; এক্কেবারে সরলরেখার মত। অফিস যাই, বাসায় আসি খাইদাই ঘুমাই। সেই আমার জীবনে এরকম ঘটনা ঘটবে কখনো ভাবিনি।
এইতো সেদিনের ঘটনা। হঠাৎ রতন ভাই এর ফোন। "কিছু টাকা লাগে, দিতে পারবেন?” । ব্যবসায়ী মানুষ। যখন তখন টাকার প্রযোজন হয়। অনেকবারই নিয়েছেন আমার কাছ থেকে এবং সময়মত ফেরৎও দিয়েছেন। আমার পুরোনো কলিগ - চাকরী ছেড়ে এখন ব্যবসায়ী। আমার দেখা লাক্ ীমানুষদের একজন। শুন্য থেকে শুরু করে প্রায় কোটি টাকার মালিক হয়ে গেছেন। মাত্র কয়েক বছরেই।
ব্যাংক থেকে টাকা তুলে হাটতে শুরু করলাম। দৈনিক বাংলা থেকে সিটি হার্ট, আমার কাছে অল্পই দুর। গলি পথে ঢুকে পরলাম। অনেকবারই গিয়েছি এই পথে। কয়েক ব্লক পার হয়ে বুঝলাম একটু ভূল করেছি। অন্নমনস্ক ছিলাম বলে খেয়াল করিনি। ভুল রাস্তায় চলে এসেছি। পেছনে যাব? ধেৎ, এসেই যখন পড়েছি, দেখি কি হয়। আমি এগোতে থাকি। সিটি হার্টেও লোকেশন আন্দাজ করে ডানে বায়ে করে এগুতে থাকি। এদিকটা একটু নির্জন। আবাসিক এলাকা বলে হয়তো। লোকজনের চলাফেরা কম। সামনে মনে হচ্ছে আর রাস্তা নেই। ভুল করে কানা গলিতে ঢুকে পড়েছি। অথচ আমার মনে হচ্ছে ওপাশেই আমার গন্তব্য। আমি এগোতে থাকি।
যাক যা ভেবেছিলাম তাই। দুটো বিল্ডীং এর মাঝদিয়ে সরু পথ - ড্রেন। ময়লা আবর্জনাও দেখা যাচ্ছে। খুব সম্ভবতঃ ব্যবহার কম হয়। আমি এক দমে দ্রুুত ওপারে মুল রাস্তায়্ চলে এলাম। সামনেই সিটি হার্ট। যাক বাবা। তবুও ভাল ঘুরতে হয়নি।
রতন ভাইকে টাকা দিলাম। উনি এলাকার বিখ্যাত হালিম এনে খাওয়ালেন। টাকাটা বললেন ১ মাস পরেই ফেরৎ দেবেন। ওটা নাকি উনার অন্য ব্যবসায়ী পার্টনারদের জন্য। আমাকে ৪ হাজার টাকা ধরিয়ে দিলেন। আমার প্রশ্নবোধক চেহারা দেখে কৈফিয়াৎ দিলেন। মার্কেট রেট এখন লাখে দুই থেকে আড়াই। তাই দুই লাখের জন্য অ্যাডভান্স ৪ হাজার। ”আপনার টাকা; অতএব আপনাকেই তো দেব তাইনা”। এতদিন খাওয়াদাওয়ার উপর দিয়েই চলেছে। তাই বলে নগদ টাকা। আমি গাই গুই করতে উনি বোঝালেন যে, তার পার্টনার অন্য যায়গা থেকে নিলে ৫ হাজার টাকা লাগত। উনি ৪ হাজার দিয়ে পেয়ে খুশি। আমি এমনিতেই দিতাম কথাটা শুনে উনি বোঝালেন - তাহলে সিস্টেমটা নষ্ট হয়ে যায়।
কি আর করা। টাকাটা নিয়ে নিলাম। অবশ্য কারনও আছে। অফিসের কলিগরা কয়েকদিন যাবৎ খাই খাই করছে আমার কাছে। টাকাটা দিয়ে ওদেও খাইয়ে দেয়া যাবে। কইয়ের তেলে কই ভাজা আরকি!
ফিরতি পথে হঠাৎই নতুন আবি¯কার করা পথের কথা মনে হল। এবার তো কোন অসুবিধা নাই। পথটা চেনা রইল। আবারও এক দমে দুই বিল্ডীং পার হয়ে গলিপথে উঠলাম। আগের মতই নির্জন পথ।
হাটছি। হঠাৎ কে যে হাত ধরে টান দিল। ফিওে তাকিয়ে দেখি - ওরেব্বা, পাগল নাকি। আমার হাত ধরে আছে। ট্কাা দিয়ে যা। খিদা লাগছে।আমি ঝটকা টানে হাত ছাড়িয়ে নিলাম।
খুব খিদা লাগছে। দিয়া যা। তোর কাছে আছে আমি জানি। আমারে ভুখা রাইখা তুই অন্যগোরে খাওয়াবি?
কি মুশকিল। আমি পকেটে হাত দিয়ে মানিব্যগ বের করি। রতন ভাইয়ের দেয়া টাকা ছাড়া আর অল্প কিছু আছে। অন্য পকেট হাতড়ালাম। নাহ্ কোন ভাংতি টাকা নেই।
হঠাৎই মনে হল। দিয়ে দেইনা ওকে টাকাটা। পুরো চার হাজারই। এ টাকা তো আমার পাবার কথা ছিলনা। হঠাৎই সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললাম; ওকেই দিয়ে দেব। যেন আমার মনের কথা পড়ে ফেলল লোকটি।হ দিয়া যারে সব। আইজ একবার যা দিবি প্রতিদিন তাই পাইবি।
ওর পাগলামি কথায় মনে মনে রেগে যাই। প্রায় বের করে ফেলেছিলাম টাকাগুলো। আবার ভরে রাখলাম। বেটা ভন্ডামীর যায়গা পেলনা। অবশ্য টাকাগুলো না দেবার পক্ষে সায় দেয়ার জন্য অবচেতন মনের এই কপট রাগ!
পকেট হাতড়ে ৫ টাকার কয়েনটা খুজে পেলাম। নে বেটা যা ফোট।
টাকাটা নিয়ে অদ্ভুত একটা হাসি ফুটিয়ে তুলল সে মুখে। ”বিশ্বাস করতে পারলিনাতো। পরে পস্তাবি।”
আমার মেজাজ খারাপ হয়ে গেল। তাও ভাল টাকাটা দেইনি। ব্যাটার চেহারাটা এখন একদম হেরোইন সেবীর মত লাগছে।
ঘটনাটা ভুলেই গিয়েছিলাম। যদিও তার পরদিনথেকে প্রতিদিন বিভিন্নভাবে ৫টাকার কয়েন পেয়েছি। পথে কুড়িয়ে পাওয়া টাকা পয়সা আমি সাধারনতঃ ভিক্ষুকশ্রেণীর মানুষদের দিয়ে দেই। কিন্তু এই কয়েন গুলো এমন সময় এমন যায়গায় পেয়েছি যে দিয়ে দিতে পারিনি। আর টাকা প্রাপ্তির বিষয়টাকে বিচ্ছিন্ন ঘটনা বলেই ধরে নিয়েছি।
কিন্ত আজকের ঘটনাকে কোনভাবেই বিচ্ছিন্ন বলে উড়িয়ে দিতে পারছি না। সকালে হানিফকে পাঠিয়েছিলাম তরমুজ কিনে আানার জন্য। তরমুজের সাইজের কারনে প্রতিদিনই কিনতে চাইলেও কেনা হয়ে উঠেনা। এদিকে সিজন শেষ হয়ে যাচ্ছে। প্রিয় ফলটা কি এবছর খাওয়া হবেনা?
যাই হোক, হানিফ বাজার থেকে বিশাল সাইজের তরমুজটা নিয়ে এলো। আমর তরমুজ খাওয়ার স্টাইলটা একটু অন্যরকম। তরমুজের মাঝখানে কেটে চামচ দিয়ে আলতো করে কেটে কেটে খাওয়া। যথারীতি দুই ভাগ করে চামচ নিয়ে বসে গেলাম। কিছুক্ষন খাওয়ার পর চামচ ঢুকাতেই হঠাৎ ধাতব শব্দু হল। সেকি। তরমুজ আবার --- আমি খুচিয়ে জিনিসটা বের করলাম। আরে, একটা চকচকে পাচ টাকার কয়েন। সেকি!! আমি অবাক হয়ে আমার স্ত্রীকে ডাকার জন্য হাক দেব। এমন সময় হঠাৎ সেই পাগল, গতকয়েকদিনের ঘটনা মনে পড়ে আমরা শীরদারায় শীতল একটা স্রোত বেয়ে গেল।
এরমানে কি? তরমুজের ভিতর কয়েন আসবে কি করে? রাস্তায়, বাসের সিটে এমনকি বইয়ের ভাজে কয়েন পাওয়ার ঘটনাকে স্বাভাবিক ধরে নিয়েছি। কিন্তু তরমুজের ভিতর?? আচ্ছা আমি কি সত্যি সত্যিই এখন থেকে ৫টাকার কয়েন পেতে থাকব? মনের ভিতর একটা আফসোস উকি দিল - সবগুলো টাকা পাগলটাকে দিয়ে দিলে কি সত্যি সত্যিই ৪ হাজার টাকা করে করে পেতাম? পেলে কিভাবে পেতাম? কেন ওদিন ওকে সব টাকা দিয়ে দিতে দেইনি? অবিশ্বাসের শা¯িত স্বরুপই কি আমার এই টাকা প্রাপ্তি? কতদিন পার এই টাকা?
কি ভেবে ঐ গলি পথে পাগলটিকে খুজতে)বের হলাম; কোন কারন ছাড়াই। জানি তাকে পাওয়া যাবেনা। সিটি হার্টের এপাশ দিয়ে দুই বিল্ডিং এর মাঝের পথটি গ্রিল দিয়ে আটকানো। পাশের দোকানীকে জিজ্ঞেস করতেই সে বলল- গতবছরথেকেই (?) নাকি এপাশ দিয়ে পথটি আটকানো। ’হিরুইনচি রা যাইয়া হাইগা থোয় দেইখা বাড়িওয়ালা বন্দ কইরা দিছে।” বুঝলাম বৃথা চেষ্টা করে লাভ নেই।
কাউকে বলিনি এক ঘটনার কথা। এমনকি আমার স্ত্রীকেও না। দরকার কি? কেউ কি বিশ্বাস করবে? আর এটা কি বিশ্বাস করার মত ঘটনা? আবার হঠাৎই মনে হয় আজকের ঘটনারও একটা ব্যাখ্যা আছে।
দেখা যাক কি হয় আগামীতে।
তবে আপনাদের জানানোর জন্যই লিখে ফেললাম, বিশ্বাস অবিশ্বাস আপনাদের ব্যাপার। হয়তো কোন একদিন আপনিও ঘটনার শিকার হয়ে পস্তাবেন - -ঠিক আমারই মত।

No comments: